ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোতল, জার ও ক্যানের পানি কতটা নিরাপদ?

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৪ মার্চ ২০১৬

বোতল, জার ও ক্যানের পানি কতটা নিরাপদ?

স্টাফ রিপোর্টর ॥ ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই বোতলজাত ও জারজাত পানির একটি বড় বাজার রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে বেশিরভাগ মানুষ এখন বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তবে এ পানি কতটা নিরাপদ? বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে রাজধানীসহ সারাদেশে জার ও ক্যানে যে পানি বিক্রি করা হয় তার সবটাই নিরাপদ নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে রমরমা ব্যবসাও করছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে খোদ রাজধানীতেই প্রায় ৩শ’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করেই বোতলজাত পানির ব্যবসা করছেন। বিএসটিআই জানিয়েছে অনুসন্ধানে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় এর আগে এক শ’রও বেশি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। এসব অবৈধ পানির ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানে জড়িত ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা। তিনি জানান অভিযানে দেখা গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নামে ওয়াসার পানি বোতলজাত করে বিক্রি করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানই জারে পানি রিফিল করার সময় জারগুলো জীবাণুুমুক্ত করছে না। জীবাণুমুক্ত করতে হাইড্রোজেন পার অক্সিসাইড ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পদার্থের কোন ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া জারে পানি রিফিল করার সময় ফিলিং মেশিন ব্যবহার করার কথা থাকলেও শুধু ফিল্টার ব্যবহার করে পানি ভর্তি করা হচ্ছে জারে। আবার ফিলিং মেশিনের আল্ট্রাভায়োলেট রেও’র অনেক পতিষ্ঠানের নেই। পানির ময়লা ছাঁকতে ফিল্টার ব্যবহার করলে এতে পানির ময়লা ছেঁকা হলেও জীবাণু ছেঁকা যায় না। মূলত রে’র মাধ্যমে জীবাণু ধ্বংস করা হয়। একটি প্রমাণ সাইজের রে’র বাল্বের মূল্য পনেরো হাজার টাকা। একবার এ বাল্ব নষ্ট হলে তা পরিবর্তন করাও হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠানে আল্ট্রাভায়োলেট রে মেশিনটিই পাওয়া যায়নি অভিযানের সময়। নিয়ম অনুযায়ী জারে বা বোতালে পানি বাজারজাত করতে হলে অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে একজন করে কেমিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠানে কেমিস্ট ছাড়াই পানি বোতলজাত করা হচ্ছে। পানি উৎপাদন করে প্রতি ব্যাচ পানি একজন কেমিস্ট কর্তৃক পরীক্ষার পর তা বাজারজাত করা উচিত। ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জানান ২/১টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও কেমিস্ট পাওয়া যায় না। একটি ল্যাবরেটরি থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কিছু কারখানায় ল্যাব পাওয়া গেলেও তা ব্যবহার হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব ল্যাবে ধুলার স্তর জমে থাকতে দেখা যায়। অনেক কারখানায় পানি পরীক্ষার রিপোর্টও পাওয়া যায়নি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি উৎপাদন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে ভাঙ্গা নোংড়া ঘরে, সিঁড়ির নিচে, মুরগির আড়তের ভেতর, রেললাইনের পাশে খোলা ঘরেও খাবার পানি তৈরির কারখানা স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানির নামে জার ভর্তি করা হচ্ছে। জারগুলো যে প্রতিষ্ঠান, হোটেল রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করা হয় খালি হওয়ার পর তা অত্যন্ত অনাদরে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় স্থানাভাবে বাথরুম বা টয়লেটের ভেতরেও রাখতে দেখা যায়। আবার ফেরত আনার সময় এগুলোর মুখ বন্ধ থাকে না বলে পাখির মল, ধুলা-বালি, জীবাণু খুব সহজেই এগুলোর ভেতর ঢুকে যেতে পারে। তাই জীবাণু নাশক দিয়ে জার ধোয়া জরুরী। জার ধোয়ার জন্য ওয়াশিং প্ল্যান্ট ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক হলেও জারগুলো হাতে ধোয়া হয়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা বলেন নীল রঙের ১৯ লিটার জারে পানি বেতালজাত করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই নিয়ম মেনে পানি উৎপাদন করতে হবে। বিশেষ করে রিফিল করার পূর্বে এগুলো জীবাণুমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরী। জীবাণুনাশক (যেমন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড) দিয়ে এগুলোকে জীবাণুমুক্ত করা বাধ্যমূলক। কারণ শুধু পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে দৃশ্যমান ময়লা পরিষ্কার করা হয় কিন্তু কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড প্রভৃতি পানিবাহিত জীবাণু ধ্বংস হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এক জার পানি বাজারজাত করতে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা খরচ হলেও অস্বাধু কারখানার মালিক তা বিক্রি করে ৫ থেকে ১০ টাকায়। ফলে মান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণে ভাল কারখানাগুলো বাজার হারাচ্ছে। আবার খাবার পানি ব্যবসায় ডিলার নামে মধ্যস্তত্ব শ্রেণীরও সৃষ্টি হয়েছে। এরা কারখানা হতে ৫/৬ টাকায় পানি ভরে এনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২৫/৩০ টাকায় পানি সরবরাহ করছে। ডিলাররা ৪০/৫০টি জার এবং একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে নিজেদের নামে ইচ্ছামতো পানি বাজারজাত করছে। এরা নিজেরাই জারে পানি ভরে ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে পানি সরবরাহ করে। পানি বাজারজাত এবং জার পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে পানি উৎপাদক কারখানার মালিককে কিছু ভাবতে হয় না, মালিক শুধু কল খুলে রাখে। জানা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআইর লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ওয়াসার ছাড়পত্র নেই। কিছু প্রতিষ্ঠান এগুলোর তোয়াক্কাই করে না, শুধু ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পানি জারে ভরছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এভাবে বিশুদ্ধ পানি নামে জার ও ক্যানে পানির উৎপাদন করে মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। তাদের মতে শতকরা ৭৫ ভাগ রোগজীবাণুর উৎস বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহার না করার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে। এসব রোগ প্রতিরোধে অবশ্য জার ও ক্যানে পানি বিশুদ্ধভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে কিনা তার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এখনই।
×