ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ;###;তিন শ’ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ ;###;৩ হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সুইফটের সতর্কবার্তা

রিজার্ভ চুরি তদন্তে ফিলিপিন্স যাচ্ছে সিআইডি টিম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৬

রিজার্ভ চুরি তদন্তে ফিলিপিন্স যাচ্ছে সিআইডি টিম

রহিম শেখ ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরির ঘটনায় এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দারা। কোন সার্ভার থেকে মেসেজ গেছে তা খুঁজে বের করতে সোমবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮ জন আইটি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের আরও ১৬ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। এ পর্যন্ত ব্যাংকের ভিতরে বিভিন্ন শাখায় স্থাপন করা সিসি ক্যামেরাগুলোর মধ্যে ৩শ’ সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। রিজার্ভের হিসাব পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াও ২শ’ কম্পিউটারের ডাটা ক্লোন করেছেন তারা। এদিকে রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে ফিলিপিন্সে যাচ্ছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। ওই দেশের তদন্ত টিমের সহায়তায় অপরাধী চিহ্নিত এবং চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সহজ হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে সোমবার সারা বিশ্বের প্রায় ৩,০০০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পুনর্নিরীক্ষণ করার জন্য লিখিতভাবে সতর্ক করেছে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট)। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ‘সুইফট মেসেজ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকা অর্থ লোপাটের ঘটনায় অধিকতর তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। এর আগে এ ঘটনায় গত ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার এজাহারে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি দায়ের করেন। সিআইডির পাশাপাশি র‌্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখাসহ (এসবি) অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। এসব তদন্ত সংস্থার পাশাপাশি সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনও (সুইফট) তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, মূলত চারটি বিষয়কে ক্লু ধরে তারা তদন্ত করছেন। এগুলো হচ্ছেÑ সিসিটিভির ফুটেজ, ওয়েবসাইট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও ই- মেইল। এ ব্যাপারে তথ্য-প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই তারা তদন্ত কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকে যাচ্ছেন। সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় তথ্য সংগ্রহে সোমবার সিআইডি’র ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে অবস্থান করেন। কোন সার্ভার থেকে মেসেজ গেছে তা খুঁজে বের করতে সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮ জন আইটি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের আরও ১৬ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। এর আগে রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গবর্নর, বিভিন্ন বিভাগের একাধিক নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাবাসাদ করেছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। গত পাঁচ দিনে সিআইডি কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি অপারেশন, ইনফরমেশন সিস্টেম্স ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ৪৪ কর্মকর্তাসহ ফরেক্স রিজার্ভ, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, পেমেন্ট সিস্টেম ও এ্যাকাউন্টস এ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের অন্তত ৭০ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন ও পেমেন্ট সিস্টেম ডিলিং রুমের দায়িত্বরত সব কর্মকর্তার জীবনবৃত্তান্ত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সোমবার পর্যন্ত ব্যাংকের ভিতরে বিভিন্ন শাখায় স্থাপন করা সিসি ক্যামেরাগুলোর মধ্যে ৩শ’ সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। রিজার্ভের হিসাব পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্টও ছাড়াও এ পর্যন্ত ২শ’ কম্পিউটারের ডাটা ক্লোন করেছেন তারা। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের ঘটনা একটি ট্রান্সন্যাশনাল (আন্তঃদেশীয়) অপরাধ। এ ঘটনায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসতে পারে। তবে আমরা এখনও তথ্য সংগ্রহ করছি। এ কথা সত্য যে, দেশী-বিদেশী চক্র মিলে এ কাজ করেছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ১শ’র বেশি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা এফবিআইকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের পর সিআইডি টিম ফিলিপিন্স যাবে। এজন্য আদালতের অনুমতি চাওয়ার প্রক্রিয়াসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হয়েছে। শীঘ্রই তদন্ত টিম সে দেশে যাবে। তারা বলেন, বেশিরভাগ অর্থই ফিলিপিন্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিলিপিনো পুলিশও ঘটনার তদন্ত করছে। ফিলিপিনো পুলিশ ও সিআইডির তথ্য সমন্বয় করলে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। সারাবিশ্বে সুইফটের সতর্কবার্তা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা লুট হওয়ার প্রেক্ষিতে সারা বিশ্বের প্রায় ৩,০০০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পুনর্নিরীক্ষণ করার জন্য লিখিতভাবে সতর্ক করেছে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট)। সোমবার সংস্থাটির মুখপাত্র এ সংক্রান্ত সতর্কবার্তা দিয়ে আরও বলেন, লেনদেনে ব্যাংকগুলোকে ফোন দেয়াও শুরু করবে সুইফট। মুখপাত্র বলেন, গ্রাহকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্নিরীক্ষণে উৎসাহিত করা ও যেখানে প্রয়োজন সেখানে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করাই এখন আমাদের কাছে অগ্রগণ্য। গত মাসের শুরুর দিকে অজ্ঞাত হ্যাকাররা সাইবার হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্ক ফেডারেল ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে ৮০০ কোটি টাকা ফিলিপিন্সের কয়েকটি এ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেয়। এ যাবতকালের ইতিহাসে সাইবার হামলা চালিয়ে অর্থ লুটের ঘটনার মধ্যে এটি অন্যতম। এখন পর্যন্ত সুইফট এ হামলার ব্যাপারে খুব বেশি কিছু না বললেও এই ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত ত্রুটির কারণে ঘটেছে বলে তারা ইঙ্গিত দিয়েছে। পূর্বে হ্যাকারদের হামলা থেকে সুরক্ষার জন্য গ্রাহকদের যেসব নিরাপত্তাজনিত পরামর্শ দেয়া হয়েছিল সুইফট তার একটি সামারি তৈরি করছে বলে মুখপাত্র জানিয়েছেন। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা গত বুধবার একটি অভ্যন্তরীণ গোপন তদন্ত রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, হ্যাকাররা ব্যাংকের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সুইফট মেসেজের গোপন কোড চুরি করেছে এবং ‘সংবেদনশীল’ ম্যালিসিয়াস সফটওয়্যার ব্যবহার করে কম্পিউটারে হামলা চালিয়ে লেনদেন সম্পন্ন করেছে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে নতুন গবর্নরের বৈঠক ॥ দেশের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গবর্নর ফজলে কবিরের সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা। এ সময় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে কাজ করার পাশাপাশি সুইফট কোড মেসেঞ্জিং সিস্টেমের নিরাপত্তার জোরদার করার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নবনিযুক্ত গবর্নর ফজলে কবিরকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে আসেন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা। এ সময় ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে গবর্নর ও ডেপুটি গবর্নরদের সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উর্ধতন কর্মকর্তাদের আলোচনা হয় বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা। সৌজন্য সাক্ষাত শেষে, নতুন গবর্নরকে দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান ব্যাংকগুলোর উর্ধতন কর্মকর্তারা। এ সময় সুইফট কোডের ব্যবহারের সতর্কতা ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার।
×