ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন সবজি টমাটিলো

দেখতে টমেটোর মতো, সুস্বাদু পুষ্টিকর- ডায়াবেটিসে উপকারী

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২১ মার্চ ২০১৬

দেখতে টমেটোর মতো, সুস্বাদু পুষ্টিকর- ডায়াবেটিসে উপকারী

বশিরুল ইসলাম ॥ দেখতে ঠিক টমেটোর মতো, পুষ্টিকরও বটে। এটি এক ধরনের নতুন সবজি। নাম টমাটিলো। কাঁচা খেতে বেশ সুস্বাদু। তবে মিষ্টি কম হওয়ায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুবই ভাল এই নতুন সবজি। টমাটিলো শুধু রোগ নিরাময়কারী নয়, এটি কীটনাশক, বিষমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব একটি সবজি। দেশে প্রথম চাষ করা এ টমাটিলো কোন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত হয়েছে। ফলে এ শস্য উৎপাদনে একদিকে পরিবেশ যেমন অপরিকল্পিত বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি কৃষকের উৎপাদন খরচও অনেক কমে যাবে। প্রোটিন, ভিটামিন সি আর ক্যারোটিনসমৃৃদ্ধ এ সবজি, মানবদেহে যেমন পুষ্টি যোগাবে তেমনি ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করতে পারে এই টমাটিলো। এটি রান্নার পাশাপাশি কাঁচা কিংবা পাকাও খাওয়া যায়। মেক্সিকোতে জনপ্রিয় এই টমাটিলো বাংলাদেশের মাটিতে চাষযোগ্য করার চেষ্টায় বেশ সফল হয়ে সাউ টমাটিলো-১ ও সাউ টমাটিলো-২ নামে দুটি নতুন সবজি জাত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রতি অবমুক্ত করা হয়েছে। টমাটিলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স এ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নাহিদ জেবার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ও এমএসের শিক্ষার্থীদের একটি দল দীর্ঘদিন ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশের ৫টি অঞ্চলে ট্রায়াল দেয়ার পর আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ায় জাত দুটি অবমুক্ত করেন। সাউ টমাটিলো ১ সবুজ রঙের এবং সাউ টমাটিলো ২ বেগুনি রঙের। কীটনাশকমুক্ত চাষাবাদের সুযোগ ও ফলন বেশি পাওয়ায় সবজিটি নিয়ে আশান্বিত গবেষক-কৃষক সবাই। টমাটিলোতে টমেটোর তুলনায় এক মাস আগেই ফুল ও ফল ধরে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ফসল পাওয়া যাবে বলে কৃষকগণ মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে অন্য আরেকটি ফসল চাষ করতে পারবে। হেক্টর প্রতি সাউ টমাটিলো ১ এর ফলন ৭০ টন এবং সাউ টমাটিলো ২ এর ফলন ৩৫ টন। যা দেশি টমাটোর চেয়ে দ্বিগুণ। তার এই সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা এ দলটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. নাহিদ জেবা বলেন, কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করতে নতুন এ সবজিটির মাল্টি লোকেশনাল ইল্ড ট্রায়াল (জাত অবমুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া) সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রামের পটিয়া, ঝিনাইদহের দত্তনগর, দিনাজপুরের চেহেল গাজী মাজার ও পটুয়াখালীর দশমিনাতে টমাটিলো চাষ করে আশানুরূপ ফল পাওয়া জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে কৃষক পর্যায়ে এটি অবমুক্ত করা হয়েছে। ড. নাহিদ জেবা বলেন, টমাটিলো দেখতে আমাদের দেশের একটি সাধারণ আগাছা ‘ফোসকা বেগুন’র মতো বৃতির দিয়ে মোড়ানো। ভেতরের ফলটি কাঁচা টমেটোর মতো। পরিপক্ব অবস্থায় মোড়ানো বৃতি ফেটে যায় এবং ফলটি বেরিয়ে আসে, তখন এটিকে হলুদাভ দেখায়। বৃতিটি ধীরে ধীরে বাদামি বর্ণ ধারণ করে। টমাটিলোর ভেতরের অংশ ভরাট, টমেটোর মতো কিছুটা ফাঁপা ও জলীয় নয়। খেতে সুস্বাদু এবং টক-মিষ্টি। সবুজ, সতেজতা ও টার্ট ফ্লেভার, রান্নার স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। টমাটিলোর ভেতরের অংশে রসালো পাল্প ও ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ থাকে। টমাটিলোর উৎপত্তি মেক্সিকোয়। বাংলাদেশে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক্স এ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নাহিদ জেবা এই ফসলটির সর্বপ্রথম বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ায় এর পরীক্ষামূলক চাষ করেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি এর ওপর বিভিন্ন গবেষণা করেন। তিনি জানান, উৎপত্তি মেক্সিকোয় হলেও আমাদের দেশীয় জলবায়ু ও মাটি টমাটিলোর অনুকূলে থাকায় গড় উৎপাদন মেক্সিকোর তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এদিকে প্রচলিত টমেটো চাষে প্রয়োজন হয় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। অন্যদিকে টমাটিলোতে কোন রকম কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করেই ফলন পাওয়া যাচ্ছে হেক্টর প্রতি ৭০ টন। কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই টমাটিলো উৎপাদন করায় একদিকে এর চাষ প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে পরিবেশবান্ধব, অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচও কমে যাচ্ছে বহুগুণে। জমি চাষের সময় কেবল বেসাল ডোজ হিসেবে সামান্য রাসায়নিক সার ও গোবর ব্যবহার করা হয়। প্রতি গাছে ৪-৫ কেজি ফলন হওয়ায় বাঁশের খুঁটি প্রয়োজন হয়। একই মাপের টমেটো ও টমাটিলোর তুলনা করলে দেখা যায় টমাটিলোর ওজন বেশি কারণ টমাটিলোর ভেতরটা ফঁঁপা নয়। টমাটিলোর গায়ে বৃতির আবরণ থাকায় পোকামাকড়, টমেটোর মতো পাতা মোড়ানো রোগ ও ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকে। স্বল্প সময়ের উচ্চ ফলনশীল সবজি টমাটিলো কৃষকের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ফসল এবং টমাটিলোর বীজ কৃষকগণ নিজেই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারবে।
×