ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জিয়াকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের বীর অধিনায়ক ॥ বিএনপি কাউন্সিলে ভাষণ

খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও দ্বিকক্ষ সংসদের ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২০ মার্চ ২০১৬

খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও দ্বিকক্ষ সংসদের ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে দলের কাউন্সিলে দেশ পরিচালনার রূপরেখা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ‘ভিশন-২০৩০’ নামের এ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ও সংবিধানে গণভোট চালু করা হবে। শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্য প্রদানকালে ‘ভিশন-২০৩০’ রূপরেখা দিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্যের আগে দলের লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিডিও রেকর্ড করা বক্তব্য কাউন্সিলে আগতদের শোনানো হয়। ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি না করে দেশে নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করবে জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করব না। নিজেরাও দুর্নীতি করব না, অন্যদেরও দুর্নীতি করতে দেয়া হবে না। দুর্নীতি বন্ধ করতে ন্যায়পাল আবারও কার্যকর করা হবে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে কাউকে হেনস্তা করা হবে না, কারও প্রতি অবিচার করা হবে না। দেশবাসীকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের যে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ছিনিয়ে আনুন। আমিও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আপনাদের সঙ্গে আছি। দেশে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো সময়ের দাবি। সংলাপ হলে আর আন্দোলন লাগবে না। এর মাধ্যমে অন্ধকার দূর করে আলোর আভা ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বে¡ও আমরা ঐক্যের অভাবে পিছিয়ে পড়ছি। তিনি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে বিএনপি সব সময় তৎপর। সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করে যাব। দেশের ভূখ-ে কোন সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা মেনে নেব না। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে কার্যকর ব্যবস্থা নেব। আবেগজড়িত কণ্ঠে খালেদা জিয়া বলেন, আমার ছোট ছেলে কোকো ৭ বছর পর লাশ হয়ে আমার কাছে ফিরেছে। বড় ছেলেকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। সে এখন চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, মামলা, হামলা ও অত্যাচার চালিয়ে বিএনপিকে ধ্বংস করা যায়নি, ধ্বংস করা যাবে না। আমাদের চরম দুঃখের দিন শীঘ্রই কেটে যাবে। বিএনপির জন্য এখন কঠিন সময় হলেও কাউন্সিলের মাধ্যমে আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে। কাউন্সিলে আগত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় জীবনের এক চরম সঙ্কট সন্ধিক্ষণে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে স্বাধীনতার মাস মার্চে এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমি সেই শহীদদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কাছে প্রতিবেশী ভারতসহ যে সকল দেশ ও বন্ধুপ্রতিম জনগণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিলেন, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ মরহুম জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা স্মরণ করছি। তাঁরা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের বীর অধিনায়ক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শের দিশারী জিয়াউর রহমানের প্রতি। বিএনপির দীর্ঘ সংগ্রামের পথে যারা জীবন দিয়েছেন, আহত ও নিহত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আমি তাদের প্রতিও আন্তরিক সমবেদনা ও সম্মান জ্ঞাপন করছি। আমাকে আবার চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীর প্রতি। খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র নেই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ নেই। সত্যিকারের বৈধ সরকার নেই। কোথাও কোনাজবাবদিহিতা নেই। সুশাসন নেই। সুবিচার ও ন্যায়বিচার নেই। নারীর সম্ভ্রম ও মানবাধিকার আজ বিপন্ন। শিশুরা পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। আছে শুধু স্বেচ্ছাচার, অনাচার, দুঃশাসন, দুর্নীতি আর চরম নৈরাজ্য। জাতি হিসেবে আমারা আজ সঙ্কট কবলিত, আর ভবিষ্যত অন্ধকার ও অনিশ্চিত।’ আমাদের এই কাউন্সিল থেকে জাতীয় জীবনের সেই জমাটবাধা অন্ধকার দূর করে আলোর আভাস আনতে হবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, জাতিকে আজ বিশৃঙ্খল, বিভক্ত, হতাশ ও দিশেহারা করে ফেলা হয়েছে। এই জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সব স্তরে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। সঞ্চারিত করতে হবে নতুন আশাবাদ। জনগণকে দিতে হবে পথের দিশা। বিএনপির পরম গৌরবের বিষয় হচ্ছে, জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছিলেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত করেছিলেন। জনগণের মৌলিক-মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। বিশৃঙ্খল ও হতাশ জাতিকে মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য এবং উৎপাদন ও উন্নয়নে গতি সঞ্চার করে দেশকে কর্মমুখর করে তুলেছিলেন। খালেদা জিয়া বলেন, দুনিয়া এখন বদলে গেছে। একুশ শতকে এসে জাতিসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে। ঐক্য, শৃঙ্খলা, মেধা, যোগ্যতা এবং সমন্বিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের মাধ্যমে চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করে যে যার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। খালেদা জিয়া বলেন, মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি কেবল ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং সমন্বিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের অভাবে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপিই শুধু পারে ইতিবাচক সম্মুখপ্রসারী ধারাকে এগিয়ে নিতে। এই যে ইতিবাচক ও ভবিষ্যতমুখী রাজনীতি ও পরিকল্পনার কথা আমরা বলছি, এগুলো কেবল কথার কথা নয়। আমরা যা বলি তা বুঝে শুনে বলি এবং বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করি। বিরোধী দলে থেকেও বিএনপি দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে সৃজনশীল ও গঠনমূলক রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কখনও ক্ষমতাসীনদের অনুকূল ও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেনস, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমাদের স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যকলাপ চালাতে দেয়া হয়নি। হত্যা ও গুমসহ সব ধরনের জুলুম-নিপীড়ন ও হামলা-মামলায় আমাদের সকলকে অতিষ্ঠ করে রাখা হয়েছে। এত কিছুর মধ্যে থেকেও দেশের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি এবং জনগণের দুর্দশা ও হতাশা আমাদের ব্যথিত করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, দেশ-জাতিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছি। দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। সকলের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধ দেশ এবং আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিএনপি ইতোমধ্যেই ‘ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে, অচিরেই এই ‘ভিশন-২০৩০’ চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, এই ভিশন-২০৩০’ এর আলোকেই ভবিষ্যতে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করা হবে। খালেদা জিয়া বলেন, কাউন্সিলে আমি ভিশন-২০৩০ থেকে এর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরতে চাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে দেশের সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষ, পাহাড় ও সমতলসহ সকল অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি অংশীদারিত্বমূলক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন, জনকল্যাণমূলক, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা বিএনপির লক্ষ্য। আমরা এমন এক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই, যেখানে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন ও পরিপুষ্ট করতে চাই, যাতে বহু বর্ণের ছটায় উদ্ভাসিত একটি সমাজ গড়ে উঠবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ‘রেইনবো নেশনে’ পরিণত হবে। খালেদা জিয়া আমরা ‘ওয়ান ডে ডেমোক্রেসিতে’ বিশ্বাসী নই। জনগণের ক্ষমতাকে কেবল নির্বাচনের দিন বা ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না বিএনপি। জন-আকাক্সক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করব আমরা। সুধীসমাজ, গণমাধ্যম, জনমত জরিপ, জনগণের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া, বিশেষজ্ঞ মতামত ও সব ধরনের অভিজ্ঞানের নির্যাস গ্রহণ করে দেশ পরিচালনাই বিএনপির লক্ষ্য। আমরা গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে পরস্পরের বিকল্প নয়, সম্পূরক মনে করি। আমরা জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। তাই তাদের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে চাই। তিনটি ‘গুড’ বা ‘সু’ অর্থাৎ থ্রি-জি-এর সমন্বয় ঘটাতে চাই আমরা। এই থ্রিজি হলো- গুড পলিসি, গুড গভরনেন্স এবং গুড গবর্নমেন্ট। অর্থাৎ সুনীতি, সুশাসন এবং সু-সরকার। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধা-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণমুক্ত করা হবে। আইনী ও প্রক্রিয়াগত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এগুলোর দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। বিএনপি দরিদ্রবান্ধব ও সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে এবং এর সুফলের সুষম বন্টনের মাধ্যমে দারিদ্র ও বৈষম্যের সমস্যাকে মোকাবেলা করতে চায় বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। এর জন্য বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ‘ডবল ডিজিটে’ উন্নীত করার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ নেয়া হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সবধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন ও পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিংবা দলীয় আনুগত্যের বিষয় বিবেচনায় নেয়া হবে না। মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, সততা ও সৃজনশীলতা হবে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে যোগ্যতার মাপকাঠি। আইনানুগভাবে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কর্তব্য পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দলীয় ও অবাঞ্ছিত সব হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং আটক অবস্থায় দৈহিক-মানসিক অমানবিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। সব ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ থেকে মানুষকে মুক্ত করা হবে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবে বিএনপি। নিয়োগের জন্য বাছাই বা সুপারিশকৃতদের ব্যক্তিগত তথ্য ও সম্পদ বিবরণী জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। খালেদা জিয়া বলেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখ-তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের ভিত্তি ও বিন্যাস প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংবিধানে জনগণকে সব ক্ষমতার মালিক করা হবে। সব স্তরে ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। সাংবিধানিক পদের নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার করা হবে। এসব পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গণশুনানির ব্যবস্থা থাকবে। খালেদা জিয়া বলেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা ও তদারকি নিবিড় ও শক্তিশালী করা হবে। যোগ্য, সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের বেসরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা বোর্ডে নিয়োগ দেয়া হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। বিচার, প্রশাসন, পুলিশ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুত ও খাবার পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, পরিচ্ছন্নতা সেবাসহ সব প্রকার রাষ্ট্রীয় ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহের সেবার মান ক্রমান্বয়ে উন্নত করা হবে। ভেজাল রোধে এবং ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনী ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। খালেদা জিয়া বলেন, ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দমনে কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করে যাব। বিএনপি মনে করে, সন্ত্রাসবাদ সকল রাষ্ট্রের জন্যই হুমকির কারণ। এ কারণে বিএনপি বাংলাদেশের ভূখ-ের মধ্যে কোন রকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বরদাশ্ত করবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে অপর কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাও মেনে নেবে না। দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকার সমস্যার সমাধান, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধর্মগ্রন্থসমূহের মূল্যবান বাণীর ব্যাপক প্রচার এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপকে উৎসাহিত করা হবে। শিক্ষা, প্রযুক্তির প্রসার ও মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষাকে কর্মমুখী ও ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। এক দশকের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা হবে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে সমৃদ্ধ। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হবে। মেয়েদের জন্য স্নাতক এবং ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য জাতীয় টিভিতে পৃথক একটি চ্যানেল চালু করা হবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটির ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশকে তাল মিলিয়ে চলায় সক্ষম করা হবে। সুষম ও নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যস্ত ও বিকশিত করা হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হবে। কৃষকদের জন্য শস্যবীমা কর্মসূচী চালু করা হবে। নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন করা হবে। বিএনপি অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোন রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্য সৃষ্টি করবে না। অন্য কোন রাষ্ট্রও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সোহার্দ্য, বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াতে কানেকটিভিটি স্থাপন, সম্প্রসারণ ও জোরদার করতে বলিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া হবে। খালেদা জিয়া বলেন, কাক্সিক্ষত ডবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির জন্য বিএনপি যথোপযুক্ত পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করবে। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে রেল ও নৌপথকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হবে। সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়নের মাধ্যমে সারাদেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কর্মসংস্থান হবে বিএনপির অন্যতম অগ্রাধিকার। তৈরি পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিটেন্স আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি করা হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারী খাতকে সম্পৃক্ত ও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে। খালেদা জিয়া বলেন, স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এবং জনগণের অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে বিএনপি আন্দোলন করছে। দেশজুড়ে এখন ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে। অসংখ্য পরিবারে স্বজন হারানো কান্নার রোল এখনও থামেনি। আপনারা অনেকেই দৈহিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এবং চরম নির্যাতিত হয়েছেন। অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বাড়িঘরে ঘুমাতে পারেন না। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। বয়োবৃদ্ধ প্রবীণ নেতা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের তরুণ কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত প্রায় সবাই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত। এই চরম দুঃখের দিন কেটে যাবে। কারণ, এই জুলুম ও অস্থিরতা বাংলাদেশ বহন করতে অক্ষম। খালেদা জিয়া বলেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুঃখ বেদনাকে বুকে চেপে আমি এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের কল্যাণে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই কঠিন সংগ্রামে আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের সহযোগিতাই আমার পাথেয়। তিনি বলেন, সন্ত্রাস-দুর্নীতি-লুটপাট আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শেয়ার বাজার লুঠ হয়েছে। ব্যাংকগুলো লুণ্ঠিত হচ্ছে। এখন বিদেশী হ্যাকাররা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছে। এ সরকারের আমলে ব্যাংক, এটিএম বুথ, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেও জনগণের অর্থ নিরাপদ নয়। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দেশ এক অকার্যকর রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
×