ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ নিয়ে আতঙ্কে নগরবাসী

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৯ মার্চ ২০১৬

গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ নিয়ে আতঙ্কে নগরবাসী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ নিয়ে আতঙ্ক কাটছে না নগরবাসীর। রাজধানীর উত্তরায় চুলা জ্বালাতে গিয়ে গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দুই ছেলেসহ বাবার করুণ মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মনে দাগ কেটে গেছে। গৃহিণীসহ বাসার কর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে, গ্যাসের চুলা ব্যবহারে আগের চাইতে এখন সতর্কতা অনেকটা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসজনিত দুর্ঘটনারোধে প্রথমত, বাসার গৃহিণী ও কর্তাব্যক্তিদের সচেতন হতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে বাড়িওয়ালাদেরও। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ারা বাসার মালিককে গ্যাসের চুলা লিকের কথা জানালেও তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে থাকে। তাই বাড়িওয়ালাদেরই দায়টা একটু বেশি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার সেক্টর-১৩, রোড-৩ এর ৮ নম্বর বাড়ির ৭ম তলার বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে গৃহকর্তা মার্কিন দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ, তার ১৪ মাস বয়সী ছেলে জায়ান ও বড় ছেলে শালিন (১৫) নিহত হয়। গুরুতর আহত হন শাহনেওয়াজের স্ত্রী সুমাইয়া। তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট থেকে রাজধানীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই দিন গৃহিণী সুমাইয়া রান্নাঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। নিমেষেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে ফ্ল্যাটে। দগ্ধ হন ৩ সন্তানসহ বাবা-মা। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে যায় আনন্দে ভরা একটি সংসার। অথচ শাহনেওয়াজ ওই বাসা ভাড়া নেয়ার পর সেখানে উঠেই গ্যাসের চুলা লিকের বিষয়টি বাড়িওয়ালাকে বার বার জানিয়েছেন। কিন্তু, বাড়িওয়ালা এতে গুরুত্ব না দেয়ায় দুই সন্তানসহ শাহনেওয়াজের করুণ মৃত্যু ঘটে। ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, রাজধানীতে এ ধরনের বাড়িওয়ালার সংখ্যাই বেশি। যারা গ্যাসের লাইন বা চুলায় ত্রুটি রেখেই বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন। আবার ভাড়াটিয়ারা এসব বিষয়ে অভিযোগ দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অভিযোগ কানে তোলেন না। উত্তরার ঘটনায় আতঙ্ক ও সতর্কতা দুটোই বেড়েছে ॥ রান্নাঘরে গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ বা চুলা জ্বালাতে গিয়ে গৃহিণী ও গৃহকর্মীদের দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সময় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা অতীতে হয়েছে। কিন্তু গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দুই সন্তানসহ প্রকৌশলী বাবা নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে রয়েছেন গৃহিণী ও গৃহকর্মীরা। তাদের সঙ্গে অভিভাবক ও গৃহকর্তারাও আতঙ্কগ্রস্ত। রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর ই-ব্লকের বাসিন্দা গৃহিণী নাসিমা আক্তার বলেন, রান্নাবান্না শেষে গ্যাসের চুলা নিভিয়ে রাখার অভ্যাস আগে থেকেই রয়েছে। বিনা প্রয়োজনে চুলা জ্বালিয়ে রাখা বা চুলায় কাপড় শুকাই না। কিন্তু, এর পরও আতঙ্কে থাকি। রান্নাঘরের দরজা আর আগের মতো লাগিয়ে রাখি না। বার বার চুলা চেক করে নেই, সবকিছু ঠিক আছে কি না। রাজধানীর বেইলি রোডের বাসিন্দা এবং মতিঝিলের একটি বেসরকারী অফিসের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাসায় দুই ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন। উত্তরার ঘটনায় খুব টেনশনে থাকি, কখন জানি কী হয়। যখনই ফোন দিই চুলা ব্যবহারে স্ত্রীকে সতর্ক থাকতে বলি। গ্যাস সরবরাহ কোম্পানিগুলোর ভূমিকা ॥ ঢাকাসহ সারাদেশে মোট ৬টি ডিসট্রিবিউটর কোম্পানি গ্রাহকদের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায় গ্যাস সরবরাহ করে থাকে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও ফেনীতে গ্যাস সরবরাহ করে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। রাজশাহী মহানগরী এবং সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও বগুড়ার কয়েকটি উপজেলা শহরে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। ফরিদপুর ও বরিশাল এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে থাকে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। এসব কোম্পানির পক্ষ থেকে বরাবরই গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পর চুলা বন্ধ করে রাখা ও চুলায় কাপড় না শুকাতে গ্রাহকদের পরামর্শ দেয়া হয়। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার ঘটনার পর তিতাসসহ অন্যান্য গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে পত্রিকা ও কোম্পানির নিজস্ব ওয়েবসাইটে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এতে গ্যাসজনিত দুর্ঘটনারোধে গ্রাহকদের বেশ কিছু পরামর্শ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরামর্শ হলো, রান্না শেষে চুলা বন্ধ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া, গ্যাসের লাইন বা চুলার নব ও পিতলের চাবিতে লিকেজ আছে কি না তা নিশ্চিত হয়ে রাইজারের চাবি বন্ধ করে দেয়া এবং এ অবস্থায় চুলা জ্বালানো থেকে বিরত থাকা। চুলা জ্বালানোর কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট আগে রান্নাঘরের দরজা জানালা খুলে দেয়ার পর চুলা জ্বালানো। গ্যাসের লাইনে লিকেজ হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে জানিয়ে দেয়া। সতর্কতা ছাড়াও গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণও উল্লেখ রয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে এতে বলা হয়, অবৈধ গ্যাস সংযোগে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়। এতে গ্যাস লিকেজ, বিস্ফোরণ বা অগ্নিকা-ের মতো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার সরবরাহকারী গ্যাস কোম্পানির নির্ধারিত তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের মাধ্যমে বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ গ্যাস লাইনের কাজ করানোর জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, পাইপের লিকেজ বা চুলার চাবি নষ্ট হয়ে গেলে কিংবা গ্যাসের চুলা চালু করে অন্য কাজ করতে গেলে এবং চুলার ওপরে কাপড় শুকাতে দিলে সাধারণ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। গ্যাস ব্যবহারে সচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি যে কোন প্রয়োজনে বা সমস্যায় পড়লে জরুরী ভাবে তিতাস গ্যাসের নিম্ন নম্বরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। জরুরী ফোন নম্বরগুলো হচ্ছে : মতিঝিল ৯৫৬৩৬৬৭, ৯৫৬৩৬৬৮ (২৪ ঘণ্টা); মিরপুর ৯০১৪২৯১ (সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা) এবং গুলশান ৯৮৯১০৫৪ (২৪ ঘণ্টা)। এ ছাড়া তিতাস গ্যাসের হটলাইন নম্বরেও যোগাযোগ করা যেতে পারে। নম্বরটি হলো : ০২-৯১০৩৯৬০। বিশেষজ্ঞরা যা বললেন ॥ কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, রান্না করার সময় অবশ্যই দরজা জানালা খুলে রাখতে হবে, যাতে গ্যাসের লাইন লিক হয়ে রান্নাঘরে গ্যাস জমে না থাকে। দুর্ঘটনারোধে গ্রাহক পর্যায়ে রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়ে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, মূলত গ্রাহকদের সচেতনতাই এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে। তবে, দুর্ঘটনা এড়াতে রুটিনমাফিক গ্রাহকদের কিচেন পরিদর্শনের ব্যবস্থা এবং গ্যাস সরবরাহ ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সতর্ক ভূমিকা রাখারও পরামর্শ ড. শামসুল আলমের। পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি জ্বালানিবিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, উত্তরাসহ অতীতে বিভিন্ন জায়গায় যে গ্যাসজনিত দুর্ঘটনা ঘটেছে তা গ্যাসের পাইপের লিকেজের কারণেই হয়েছে। সুতরাং আবাসিকে গ্যাসের পাইপ না দিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারই ভাল। এ ব্যাপারে গ্রাহককে উৎসাহিত করা উচিত। তিনি বলেন, আবাসিকে যেসব গ্যাসের চুলা ব্যবহার হচ্ছে তা নিম্নমানের। এগুলোর মান ভাল নয়। এ ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। গ্যাসের চুলা ব্যবহারে সতর্কতা বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, পরিবারের যিনি প্রধান তার উচিত গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহার কীভাবে করতে হয় সে সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা তৈরি করা। চুলায় লিক হয়ে গ্যাস বের হলে এক ধরনের শব্দ হবে। আর গ্যাসেরও একটা গন্ধ আছে। এগুলো অনুভব করতে হবে। এসব ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগীদের শরীরে টানা ১৫-২০ মিনিট বিশুদ্ধ পানি ঢালার পরামর্শ দেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন এ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল।
×