ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

শিশু দিবস ও রেহানার পড়াশোনা

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৯ মার্চ ২০১৬

শিশু দিবস ও রেহানার পড়াশোনা

কয়েকদিন ধরেই আব্বু-আম্মুর ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। খুব ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। সুহার সঙ্গে কথাই হয় না তাদের। সুহা রোজই ভাবে, আব্বু-আম্মুকে জিজ্ঞেস করবে তাদের কীসের এত ব্যস্ততা। কিন্তু সেই সুযোগ সে পায় না। আজ সুহা ঠিক করে রেখেছে আব্বু-আম্মু যত রাতেই বাসায় ফিরুক না কেন, সে জেগে বসে থাকবে। তাকে জানতেই হবে, তাদের এত ব্যস্ততা কী নিয়ে। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এক রকম জোর করেই জেগে রইল সুহা। তার চোখ লেগে এলো, কিন্তু সে ঘুমাল না। আব্বু-আম্মু বাসায় ফিরল এগারোটার পরে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সুহা দৌড়ে গেল। আম্মু তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন সুহা? তারপর রেহানাকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল। রেহানা সুহাদের বাসায় কাজ করে। আম্মুর ডাকাডাকি শুনে সে ছুটে এলো। আম্মু রেগে বলল, সুহা ঘুমায়নি কেন? রেহানা উত্তর দেয়ার আগেই সুহা বলল, ও তো কিছু করেনি আম্মু। ও আমার খাবার তৈরি করে দিয়েছে, আমি খেয়েছি। আমাকে ঘুমাতেও বলেছে, আমিই ঘুমাইনি। আমি তোমাদের জন্য জেগে আছি। আব্বু জুতা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, কেন মা? আমাদের জন্য জেগে আছ কেন? তোমার কিছু লাগলে তুমি ফোনে বলে দিলেই তো পারতে, নিয়ে আসতাম। জেগে থাকতে হবে কেন? সুহা উত্তর দিল না। আসলে এই কথার উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না সে। বড়রা অনেক বোকা। তারা কিচ্ছু বোঝে না। তারা একদম বোঝে না যে, সে কোন বায়না করার জন্য রাত জেগে বসে নেই, আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলার জন্যও সে জেগে থাকতে পারে। আব্বু-আম্মুর ধারণা, সুহার তাদের সঙ্গে কোন কথা থাকতে পারে না। সুহা বলল, আমি তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করব। আম্মু ভ্রƒ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের কী কথা জিজ্ঞেস করবে? সুহার খুব রাগ হলো। তার বুঝি জিজ্ঞেস করার কিছু থাকতে নেই? সে রাগটা প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আব্বু-আম্মু, তোমরা কী নিয়ে এত ব্যস্ত? সেই কোন্ সকালে বেরিয়ে যাও, আবার মাঝরাতে বাসায় ফেরো। আম্মু বিরক্ত হয়ে বলল, সেটা তোমার জানার বিষয় নয় সুহা। আব্বু আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আহা, থাক না। তারপর সুহাকে বলল, আমাদের সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে তো মা, আমরা সেটা নিয়ে ব্যস্ত। আব্বু-আম্মুর প্রায়ই অনুষ্ঠান থাকে। তারা শিশুদের নিয়ে একটা এনজিও চালায়। সেখানে পথশিশুদের লেখাপড়া করানো হয়, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়, কাপড়চোপড়-খাবারদাবার দিয়ে সাহায্য করা হয়। এসব নিয়ে প্রায় সব সময়ই কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আব্বু-আম্মু এত বেশি ব্যস্ত থাকে না। সুহা জিজ্ঞেস করল, কী অনুষ্ঠান আব্বু? আব্বু বলল, শিশু দিবসের অনুষ্ঠান মা। ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস। ওই দিন পথশিশুদের নিয়ে আমরা একটা অনেক বড় আয়োজন করব। মন্ত্রী আসবেন, আরও অনেক সম্মানিত অতিথি থাকবেন। পথশিশুদের যে অন্য সব শিশুর মতোই সমঅধিকার আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা সভা হবে, শিশু অধিকার নিয়ে র‌্যালি হবে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে খাবার, কাপড়চোপড়, উপহার বিতরণ করা হবে। অনেক বড় অনুষ্ঠান তো, সেটার আয়োজন নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সবটা বুঝে ফেলেছে এমনভাবে মাথা নেড়ে সুহা বলল, ও। তারপর জিজ্ঞেস করল, আব্বু, শিশু দিবস কী? আব্বু হাসল। বলল, মা, এটা হচ্ছে জাতীয় শিশু দিবস। এটা শুধু বাংলাদেশে পালন করা হয়। সারাবিশ্বে ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয় ২০ নবেম্বর এবং ‘আন্তর্জাতিক শিশু দিবস’ পালন করা হয় ১ জুন। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে শিশু দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস পালন করা শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। তুমি নিশ্চয়ই জানো, ১৭ মার্চ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। তিনি শিশুদের খুব ভালবাসতেন, আদর করতেন। তাই তাঁর জন্মদিন শিশুদের উৎসর্গ করে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। সুহা জিজ্ঞেস করল, কী হয় জাতীয় শিশু দিবসে? আব্বু বলল, এই যে- শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। শিশুদের জন্য নানা রকম আয়োজন করা হয়। সুহা বলল, আব্বু, জাতীয় শিশু দিবস কি সব শিশুর জন্য? আব্বু বলল, হ্যাঁ, সব শিশুর জন্য। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত। তাই তাদের প্রতি আমাদের যতœশীল হওয়া উচিত। সেই কথা স্মরণ করাতেই দিনটা পালন করা। সুহা কিছু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আব্বু-আম্মু তার সঙ্গে কোন কথা বলে না, একটুও সময় দেয় না। সে আর রেহানা বাসায় থাকে। রেহানা তারই বয়সী। কিন্তু সে সুহাকে দেখে রাখে। সকালে আব্বু-আম্মু বাসা থেকে বেরোনোর জন্য যখন তৈরি হচ্ছে, তখন সুহা তাদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আব্বু জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার সুহা? তোমার স্কুল নেই? সুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আজ শুক্রবার আব্বু। আব্বু স্বাভাবিক গলায় বলল, ও আচ্ছা। সুহা বলল, আব্বু-আম্মু, আমি কিছু বলতে চাই। আম্মু বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল। আব্বু বলল, বলো। সুহা বলল, আব্বু, জাতীয় শিশু দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে তোমরা ব্যস্ত। শিশু দিবস সব শিশুর জন্য। শিশুদের নিয়ে তোমরা অনুষ্ঠান করবে। সেখানে তোমরা বলবে, শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন, তাদের প্রতি যতœশীল হোন। আচ্ছা আব্বু-আম্মু, আমিও তো শিশু। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। কিন্তু তোমরা তো আমার প্রতি যতœশীল না। রেহানাও তো শিশু, তোমরা তো তার প্রতি যতœশীল না। যেই বাবা-মা তাদের মেয়ের প্রতি যতœশীল না, বাসায় থাকা শিশুটির প্রতি যতœশীল না, তারা কিভাবে অন্যকে বলবে শিশুদের প্রতি যতœশীল হতে? আম্মু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। আব্বু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেন মা? তুমি যখন যা চাও তোমাকে তো তাই দেয়া হয়। আর রেহানা তো বাসায় কাজ করে। ওকে নিয়ে এত ভাববার তো কিছু নেই। ও ওর মতো কাজ করে, তার বিনিময়ে ওর বাবা-মাকে আমরা বেতন দিয়ে দেই। ওকে কাপড়চোপড়, ভাল খাবার- সবই তো দেয়া হয়। সুহা বলল, আব্বু, আমি যা চাই তা তোমরা আমাকে দাও না। আমি তো চাই তোমরা আমার সঙ্গে গল্প করো, একসঙ্গে খাও, আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাও। তোমরা তো এসবের কিছুই করো না। আর তোমরা আমাকে যেমন সবকিছু চাওয়ামাত্র কিনে দাও, রেহানারও তো এসব পেতে ইচ্ছা হতে পারে। ও তো আমারই সমান। তোমরা তো ওকে এসব দাও না? একটু চুপ থেকে সে আবার বলল, আব্বু-আম্মু, তোমরা আসলে জানোই না শিশুরা কী চায়। তোমরা শুধু শিশুদের প্রতি যতœশীল হতে বলতে পারো, নিজেরা কখনও হতে পারো না। আব্বু কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগটা নামিয়ে রাখল। আম্মু জিজ্ঞেস করল, কী হলো? বেরোবে না? আব্বু বলল, বেরোব, কিন্তু অফিসে না। আমরা দু’জন সুহা আর রেহানাকে নিয়ে সারাদিনের জন্য ঘুরতে যাব। আর রেহানাকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ১০ম শ্রেণী (ইংলিশ ভার্সন) অলঙ্করণ : নাসিফ আহমেদ
×