ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহিদুল স্মরণে দেশঘরের গান

মনরে বল আমায় কোন সাধনে তারে পাওয়া যায়...

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৯ মার্চ ২০১৬

মনরে বল আমায় কোন সাধনে তারে পাওয়া যায়...

মোরসালিন মিজান ॥ চারুকলার পরিবেশটা বরাবরই অন্যরকম। চারুকলা মানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ক্যাম্পাসটা চিরচেনা গাঁয়ের আরেক রূপ। বকুলতলাটি দেশজ সংস্কৃতির মায়া দিয়ে ঘেরা। এমনিতেই ভাল লাগে। তদুপরি, শুক্রবার থেকে এখানে শুরু হয়েছে লোকগানের আসর। আয়োজক ছায়ানট। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম নির্মাতা ওয়াহিদুল হক লোকগান ভালবাসতেন। শহর নগরকে এই ধারার গানে সমৃদ্ধ করার স্বপ্ন দেখতেন। প্রয়াণের পর তাঁর স্বপ্নকে আন্তরিকভাবেই ধারণ করে আছে ছায়ানট। এই স্বপ্নের সপক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগের একটি দেশঘরের গান। প্রতিবারের মতো এবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পী-সাধকরা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। প্রথম দিনেই গান গেয়ে শহুরেদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন তাঁরা। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধন করা হয় সন্ধ্যায়। সাদামাটা উদ্বোধনী। তবে, চট্টগ্রামের বিখ্যাত গীতিকবি লোকসাধক আবদুল গফুর হালীর উপস্থিতি দারুণ রং ছড়ায়। উৎসবের উদ্বোধন করেন তিনি। প্রবীণ সঙ্গীত সাধক মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই মাইকে জানানো হয়, আবদুল গফুর হালী ২ হাজারের বেশি গানের গীতিকার! এমন তথ্য জানার পর বিস্মিত না হয়ে উপায় আছে? সবাই চোখ বড় বড় করে গীতিকারের দিকে তাকান। ৯০ বছরের জীবন। সত্যি কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা’, ‘পাঞ্জাবীওয়ালা রে পাঞ্জাবীওয়ালা’ কিংবা ‘দেখে যারে মাইজভা-ারি’ গানগুলো তাঁর লেখা। আরও বহু গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। কথা বার্তাও সরল। উৎসব উদ্বোধন করে তিনি বলেন, আমি মাটির মানুষ। মাটির গান আমি ভালবাসি। এর পর কিছুটা মন খারাপ। বলেন, এখানে আসার উদ্দেশ্য কিছুটা অভিযোগ করা। কিছুটা প্রতিবাদ জানানো। বিভিন্ন বিকৃতির সমালোচনা করে তিনি জানতে চান, গান কেন আগের মতো গান হয়ে নেই? গান শব্দটিকে উল্টো করলে দাঁড়ান গা। মানে, গান গেয়ো না। কেন? গান কেন এমন হয়ে যাচ্ছে? আক্ষেপ করেন তিনি। তবে ছায়ানটের কার্যক্রম পরিদর্শন করে তিনি অভিভূত। জোর দিয়ে বলেন, এত বড় এত মহৎ উদ্যোগ দেখে মন ভরে গেছে। ছায়ানটের মতো দেশের প্রতিটি জেলায় এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি। ওয়াদিুল হক সম্পর্কে বিশেষ না জানলেও, বলেন, ছায়ানট দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি একজন মহৎ মানুষ। এভাবে ছোটখাটো বলা। মনোযোগ দিয়ে শোনেন শ্রোতা। দ্বিতীয় পর্বে গান। ছায়ানটের বাছাই করা শিল্পী-সাধকরা যখন গলা ছাড়েন, মন সত্যি উতলা হয়ে ওঠে। শেকড় ভুলে থাকা শহুরে মানুষটিও বাইরে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে থামেন। মঞ্চের সামনে এসে চুপটি করে বসে যান। কথার পর গান গেয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেন আবদুল গফুর হালী। সে কী গলা! নিজের লেখা গান ধরেন তিনি। জাত পরিচয় তুলে ধরে গানÑ সংসার ধর্ম করছি বলে/ মিশে আছি তোদের দলে/ আমার ভাবে আমি চলি/ কার কি হয়রে ক্ষতি/ লালনের যেই জাত ছিল/ আমিও সেই জাতি...। অদ্ভুত সুন্দর এই কথা সুর ও দর্শনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়! পরের গানটি পূর্বের গানের ধারাবাহিকতা। তিনি সুরে সুরে বলে যানÑ ওরে মসজিদ গির্যা কালিবাড়ি/ দেখলাম কত তালাশ করি/ কাবা কাশি বাকি রাখি নাই/ আল্লাহ গড কৃষ্ণ হরি/ ডাকিলাম কত নাম ধরি/ আসল নাম তার খুঁজিয়া না পাই/ মনরে বল আমায়/ কোন্ সাধনে তারে পাওয়া যায়...। এমন সমৃদ্ধ কথা ও সুর উৎসব আয়োজনের যথার্থতা যেমন প্রমাণ করে, তেমনি নাগরিক মনকে নতুন করে জাগায়। প্রচলিত ভাবনার বাইরে গিয়ে ভাবতে শেখায়। এদিন আরও গান করেন নয়ন শীল। আলকাপ গান নিয়ে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কেরামত আলী সরকার ও তাঁর দল। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক গান শোনান পঞ্চানন রায়। ঝাপান গান পরিবেশন করে ঝিনাইদহের শহীদুল ইসলাম জটাধারী ও তাঁর দল। সবশেষে ছিল হাস্যরসে সমৃদ্ধ সঙযাত্রা। পরিবেশন করে টাঙ্গাইলের জহের আলী ও তাঁর দল। সব ক’টি পরিবেশনাই ছিল উপভোগ্য। তন্ময় হয়ে বাংলা লোক গানে নিজেকে খোঁজেন শ্রোতা। এর আগে ওয়াহিদুল হক ও দেশঘরের গানকে যুক্ত করে ছায়ানটের সহ-সভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলী বলেন, ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক। পাকিস্তান আমলে দুঃসময়ে যে ক’জন সাহসী মানুষ বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশের জন্য অবিরাম কাজ করেছেন, ওয়াহিদুল হক তাঁদের অগ্রগণ্য। তাঁর ও সন্জীদা খাতুনের নির্দেশিত পথে ছায়ানট পঞ্চাশের ওপর বছর পেরিয়ে এসেছে। ওয়াহিদুল হক মূলত রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। এবং শেষ জীবনে এসে তিনি উপলব্ধি করেন, এদেশের মানুষের কাছে সঙ্গীতের বাণী পৌঁছে দিতে হলে মাটির টানটি বিশেষভাবে অনুভব করতে হবে। এমন চিন্তা থেকে লোকগানকে নগরের মানুষের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াসেই ছায়ানটের ‘দেশঘরের গান’। তিনি বলেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য, বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির দেশ। সব দেশের লোকগীতিতে আধ্যাত্মিকতার বিষয় থাকে। কিন্তু বাংলার যে লোকগীতি, সেখানে ধর্মের উদার দিকটিকে তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি আমাদের লোককবিরা জীবনবাদীও বটে। কল্পনা করুন, আজ থেকে শতবর্ষ আগে বাংলার পশ্চাৎপদ সমাজে তাঁরা সাহসী উচ্চারণ করছেন একটি সম্প্রীতির দেশ গড়ার জন্য। এখন লোকগীতিরও নগরায়ন ঘটেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, লোকগীতি এর আদি রূপটি হারিয়ে ফেলছে। যে গান সাধারণ মানুষের, যে গান বাংলার মানুষকে ভাবিত করে তার সন্ধান করতেই ‘দেশঘরের গান’। ছায়ানট মনে করছে, বাংলার লোক গানের শুদ্ধতম রূপ আদী রূপ নগরবাসীর কাছে তুলে ধরা জরুরী। আজকের শহুরে প্রজন্ম মাটির গান বাংলা ঐতিহ্য সংস্কৃতির সন্ধান করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে আজ শনিবারও মুখরিত থাকবে চারুকলার বকুল তলা এবং তা দেশঘরের গান নিয়েই।
×