ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তান ভারত ক্রিকেট যুদ্ধ আজ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৯ মার্চ ২০১৬

পাকিস্তান  ভারত ক্রিকেট  যুদ্ধ আজ

মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ ভারত স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন আজ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগেই পাকিস্তান ক্রিকেটারদের তাতিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এ ম্যাচটি এ্যাসেজের চেয়েও বড় ম্যাচ। শুধু এভাবেই বিবেচনা করলে হবে না, এটা সীমান্ত দ্বন্দ্বের চেয়েও বড় করে দেখতে হবে। যেখানে ভারতের মানুষের আবেগ জড়িত।’ অশ্বিনের কথা শুনে পাকিস্তান কোচ ওয়াকার ইউনুসও যেন তেতে উঠলেন। তবে সংযম থেকে বললেন, ‘এটা আসলে দিনশেষ একটা খেলা। তবে খেলার ইতিহাস সত্যিই যুদ্ধের।’ ম্যাচের আগেই দুই দলের মধ্যে যে কথার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। ক্রিকেটারদের মধ্যে, ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যে উত্তাপ-উত্তেজনাও কাজ করতে শুরু করেছে তাও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে মনে হলো, ভারত ক্রিকেটাররাই একটু বেশি দুশ্চিন্তায় আছে। সেখানে পাকিস্তান ক্রিকেটাররা আছে স্বস্তিতে! কোন কথা নেই। সরাসরি তিন নেটে গিয়ে ব্যাটিং করতে শুরু করলেন ভারতের তিন ব্যাটসম্যানÑ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি এবং সুরেশ রায়না। রোহিতকে নেট বোলাররা, কোহলিকে তিন পেসার আশিষ নেহরা, জাসপ্রিত বুমরা ও হার্দিক পান্ডে এবং রায়নাকে তিন স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন, যুবরাজ সিং ও রবিন্দ্র জাদেজা বোলিং করতে থাকলেন। রোহিত, কোহলি ও রায়না বলগুলোকে এমনভাবে ছাত্তু বানাতে চাইলেন, আকাশে প্রতিটি বল এমনভাবে মারলেন, যেন নেট ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে। মনে হলো, পাকিস্তান পেসার মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ ইরফান, ওয়াহাব রিয়াজ এবং স্পিনার শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিকের বিপক্ষে ব্যাট করছেন। আজ যখন টি২০ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান মহারণ হবে, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত আটটায়, তখন থেকেই তো আসলে ভারত ব্যাটসম্যান আর পাকিস্তান বোলারদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবে। সেই লড়াইয়ে এখন কোন দল জিতে সে অপেক্ষাতেই আছে সবাই। ম্যাচটির আগে ভারত ১০-০ পাকিস্তান, বিশ্বকাপে এমন অবস্থাই বিরাজ করছে। ছয়বার ওয়ানডে বিশ্বকাপে লড়াই করে প্রতিবারই জিতেছে ভারত। চারবার টি২০ বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। ভারতেরই জয়জয়কার হয়েছে। এবার যখন এগারোতমবার দুই দল বিশ্বকাপে মুখোমুখি হচ্ছে, তখন কেন জানি ভারতেরই হারের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইতিহাস এবার বদলে যেতে পারে। ইতিহাস যতই ভারতের পক্ষে থাকুক, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটি হেরেই বিপাকে পড়ে গেছে ভারত। এত বেশি চাপ দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে এবার বিরাজ করছে যে, এবার অন্তত জয় পাকিস্তানের হলেও হয়ে যেতে পারে। আবার ইডেন গার্ডেনে যে কখনই নির্ধারিত ওভারের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে হারেনি পাকিস্তান, সে সাফল্যও সামনে চলে আসছে। ভারত ক্রিকেটাররা যে ম্যাচটাকে নিয়ে কতটা চাপে আছেন, তা নেট প্র্যাকটিস শেষে মহেন্দ্র সিং ধোনি আর বিরাট কোহলির প্রায় ১০ মিনিটের একাকিত্ব আলাপচারিতাতেই বোঝা যাচ্ছে। পাকিস্তান দলের ক্রিকেটাররা আছেন নির্ভার। ভারত ব্যাটসম্যান ও বোলাররা যেভাবে অনুশীলনে ব্যস্ত, যেভাবে নিজেদের সামলে নিতে চেষ্টা করছেন; পাকিস্তান ক্রিকেটাররা ঠিক তার উল্টো। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ভারত অনুশীলন করে মাঠ ছাড়ার পর যখন পাকিস্তান ক্রিকেটাররা ইডেন গার্ডেনে অনুশীলন করতে ঢুকল, বোঝাই গেল না ম্যাচ নিয়ে কোন চিন্তা আছে। আবার ইডেন গার্ডেনে ঢুকেই ব্যাটিং-বোলিং করতে শুরু করলেন না পাক ক্রিকেটাররা। সবাই হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে খুনসুঁটি করছেন। শুরুতেই যে ফুটবল খেলা দিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেটাররা অনুশীলন করতে শুরু করলেন, সেখানেও আনন্দে আত্মহারা ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং-বোলিং করে ফর্মে ফেরা শহীদ আফ্রিদি দলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন। তাকে মাঝখানে রেখে চারদিকে প্রত্যেক ক্রিকেটার দাঁড়িয়েছেন। সবাই তাকে লক্ষ্য করে পা দিয়ে ফুটবল মারছেন। আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। যেন পাকিস্তান শিবিরে উৎসব চলছে। অনুশীলনে প্রথম এক ঘণ্টা তো ব্যাট-বল হাতেই নিলেন না পাক ক্রিকেটাররা! ভারত সাংবাদিকরা আবার বলতেও চেষ্টা করেছেনÑ ‘এটা আসলে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে কোন চাপ না নেয়ার চেষ্টা চলছে। তা কোনভাবেই পাক ক্রিকেটাররা পারবেন না। ম্যাচ শুরু হতেই ¯œায়ুচাপে ভুগতে শুরু করে দেবে। যেমনটি প্রতিবার হয়।’ কিন্তু অনুশীলন দেখে তা মনে হলো না। বোঝা গেল, সব দুঃশ্চিন্তা ভারতের ঘাড়ে, সব স্বস্তি পাকিস্তানের ঘাড়ে! পাকিস্তান কোচ ওয়াকার ইউনুস অবশ্য সব চাপ যে ভারতের ঘাড়ে তা বোঝাতে চাইলেনÑ ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এটাতো সেই কবে থেকেই। তবে ক্রিকেটের যুদ্ধও বহু আগের। যে কোন ম্যাচের চেয়ে এ ম্যাচের মর্ম অনেক বেশি। সেই ম্যাচটি হচ্ছে আবার ভারতে। বিশ্বকাপের ম্যাচ। তবে এবার যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি চাপে আছে ভারত। কারণ তারা প্রথম ম্যাচেই হেরে গেছে। আর পাকিস্তান ক্রিকেটারদের মধ্যেও যে চাপ নেই, তা নয়। তবে ভারতের চেয়ে অনেক কম চাপ আছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত যে খেলেছে দল। আহমেদ শেহজাদ দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছে। মোহাম্মদ হাফিজ ফর্মে ফিরেছে। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় ভারতের বিপক্ষে কঠিন ম্যাচের আগে আফ্রিদিও ছন্দে ফিরেছে।’ যতই ব্যাটসম্যানদের কথা বলুক ওয়াকার, সব সময়ই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ভারত ব্যাটসম্যান আর পাকিস্তান বোলার বিশেষ করে পেসারদের ম্যাচ হয়ে দাঁড়ায়। ওয়াকার তা মানছেন, আবার মানছেনও নাÑ ‘আসলে বিষয়টা সেরকম নয়। যদি আগে ব্যাটিং করি, তাহলে স্কোরবোর্ডে অবশ্যই রান তুলতে হবে। তা না হলে জেতা কোন দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। আর যদি বোলিং করতে হয়, তাহলে কম রানে বেঁধে রাখতে হবে। এটাই আসলে পরিকল্পনা হতে হবে। আর এ পরিকল্পনায় এগিয়ে গেলে সাফল্য আসাও সম্ভব। তবে আমাদের বোলিং এগিয়েই থাকছে।’ সঙ্গে ওয়াকার ইডেন গার্ডেনে যে সব সময়ই ভারতের বিপক্ষে নির্ধারিত ওভারে ভাল করে পাকিস্তান, সেটিও সামনে তুলে ধরেছেন, ‘ইডেন গার্ডেন সবসময়ই আমাদের জন্য ভাল ফলই বয়ে এনেছে। আশা করছি এবারও আনবে। বিশ্বকাপে যে ভারতের বিপক্ষে কখনই জিতেনি পাকিস্তান, সেই ইতিহাসও বদলাবে। এবারই সুযোগ। ইতিহাস তো বদলায়, এমন নয় যে বদলায় না।’ আর ফল পাকিস্তানের পক্ষে গেলে বিশ্বকাপে যে এখনও ভারতের বিপক্ষে জেতা হয়নি, সেই ইতিহাস বদলে যাবে। যখন পরিকল্পনার কথা সামনে আসছে, তখন ভারতও নিশ্চয়ই পাকিস্তানকে হারানোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করে রেখেছে। অলরাউন্ডার অশ্বিন অবশ্য বিশেষ কোন পরিকল্পনার কথা জানাননি। বলেছেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা সহজ। মাঠে নামব। ভাল খেলে জিততে হবে।’ সেই জেতা যে এবার সহজ নয়, তা অশ্বিনও বুঝতে পারছেনÑ ‘চাপতো যে কোন ম্যাচেই থাকে। তবে দুই দলের মধ্যে যেহেতু যুদ্ধ এটি, প্রতিদ্বন্দ্বী দল; তাই চাপ একটু বেশি থাকবেই। সেই চাপ শুধু আমাদের আছে এমন নয়। ওদেরও আছে। যে এই চাপ জিততে পারবে, তারাই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়বে।’ সেই চাপে বারবার ভারতই জিতেছে। এবারও যদি জিতে, তাহলে ইডেন গার্ডেনে প্রথমবার পাকিস্তানের বিপক্ষে নির্ধারিত ওভারে জিতার ইতিহাস গড়বে। এবার এমন এক ম্যাচ হচ্ছে, যে ম্যাচের উত্তেজনা, উত্তাপ পুরো বিশ্বে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। ইডেন গার্ডেনে যে হবে খেলাটি। ভারতের সবচেয়ে বড় মাঠ। ৬৬ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের চেয়ে ‘তিন ডাবল’ দর্শক থাকবে। একই সুরে নিজ দেশের পক্ষে আওয়াজ তুলবে। মনে হবে যেন দুনিয়া কাঁপছে। সেই কাঁপন এখন ভারত না পাকিস্তান ক্রিকেটারদের গায়ে লাগে, সেটির জন্যই তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা সবার। সেই ১৯৫২ সাল থেকে দুই দল পরস্পরের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলে। ৬টি ওয়ানডেতে, ৪টি টি২০ বিশ্বকাপে লড়াইও করেছে। কিন্তু কখনই ইডেন গার্ডেনে দুই দলের মধ্যকার বিশ্বকাপের খেলা হয়নি। এবার প্রথমবারের মতো হবে। তাই আয়োজনও সেরকম ঘটা করে করা হচ্ছে। দুই দেশের ক্রিকেটার, সিনেমা তারকা, গায়ক, গায়িকাদের মিলনমেলা হবে। থাকবেন কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। আর সৌরভ গাঙ্গুলী তো সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বেই আছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ইডেন গার্ডেনেই পড়ে থাকলেন। ভারত দল অনুশীলন করতে আসল, সেখানেও থাকলেন। উইকেট ভালভাবে পরখ করলেন। পাকিস্তান দল অনুশীলনে আসল, সেখানেও থাকলেন। দুই দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গেই কুশল বিনিময় করলেন। গাঙ্গুলী সিএবির আসনে বসতেই এতবড় ম্যাচ ইডেন গার্ডেনে পেয়েছেন। সেই সুযোগে সবকিছু রঙিন করে তোলারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু সবকিছু সেই রঙিনই থাকবে, যদি ভারত জিতে যায়। না হলে টানা দুই ম্যাচ হেরে ভারতের বিদায় ঘণ্টা এ ম্যাচটি হারেই ঘটে যেতে পারে। ম্যাচ শুরু হতে এখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি। তার আগে কথার যুদ্ধ যে শুরু হয়েছে, তাতে আজ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি যেন সীমান্ত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধের চেয়েও বড় হয়ে উঠছে।
×