ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে ওই তিন কমিটির সঙ্গে ;###;কড়া নজরদারিতে এক ডেপুটি গবর্নর ;###;৫০ কম্পিউটারের তথ্য ক্লোন

ফিলিপিন্স হংকং শ্রীলঙ্কায়ও তদন্ত কমিটি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৯ মার্চ ২০১৬

ফিলিপিন্স হংকং শ্রীলঙ্কায়ও তদন্ত কমিটি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ টাকা চুরির ঘটনা উদঘাটনে বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপিন্স, হংকং ও শ্রীলঙ্কায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। বিদেশী তিনটি তদন্ত কমিটির সঙ্গে বাংলাদেশের তদন্ত কমিটি সর্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে। টাকা চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন ডেপুটি গবর্নর কঠোর নজরদারিতে রয়েছেন। তাকে কয়েক দফায় কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এই গবর্নরের। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট অনেকেই রয়েছেন নজরদারির মধ্যে। অনেককেই আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সিস্টেমের আওতায় অন্তত সাড়ে চার হাজার কম্পিউটার রয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে বাছাই করে শুক্রবার পর্যন্ত ৫০টি কম্পিউটারের তথ্য ক্লোন করে নেয়া হয়েছে। ক্লোন করে নেয়া সেসব ডাটা পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য সম্পর্কে আটককৃতদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শুক্রবার পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে অন্তত শতাধিক জনকে। যাদের অধিকাংশেরই জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবারও সিআইডির একটি দল তদন্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। সিআইডি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা রাখা টাকার মধ্যে ৮শ’ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় গত ১৫ মার্চ মঙ্গলবার বিকেলে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার এজাহারে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মামলাটি দায়ের করেন। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে তিনি মামলাটি দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর পরই মামলাটির তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। গত ১৬ মার্চ থেকেই সিআইডি মামলাটির আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) বিভাগের মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকীর নেতৃত্বে সিআইডির একটি তদন্তকারী দল বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। তাঁরা ব্যাংকের নানা জায়গা পর্যবেক্ষণ করেন। পাশাপাশি নানা বিষয়ে খোঁজখবর নেন। কথা বলেন অনেকের সঙ্গে। অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদও করেন। মামলা তদন্তের স্বার্থে অনেক তথ্যও সংগ্রহ করেন। বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত সিআইডির দলটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সার্ভারগুলোতে অভিযান চালান। অনেক কিছুই আলামত হিসেবে জব্দ করেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী সাংবাদিকদের জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (আন্তঃদেশীয় অপরাধ)। ঘটনাটির সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের চারটি দেশের অপরাধী চক্র জড়িত। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশে তদন্ত চলছে। পাশাপাশি অপর যে তিনটি দেশের লোক জড়িত, সেই দেশ তিনটিতেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চার দেশের তদন্ত শেষে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট মন্তব্য করা যাবে। তবে বাংলাদেশ থেকে তদন্তের স্বার্থে যা সংগৃহীত হয়েছে, সেসব আলামতের বিচার বিশ্লেষণ চলছে। সন্দেহভাজনদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই অনেকেই নজরদারির মধ্যে রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপিন্স, হংকং ও শ্রীলঙ্কায় এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির সঙ্গে বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থার যোগাযোগ চলছে। সিআইডির কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সিস্টেমের আওতায় সাড়ে ৪ হাজার কম্পিউটার রয়েছে। তদন্ত দল প্রতিটি কম্পিউটার ধরে ধরে তথ্য সংগ্রহ করছে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের অপারেটরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মূলত ঠিক কোন কম্পিউটার থেকে ঘটনাটি ঘটেছে তা সুনির্দিষ্ট করার জন্যই এমন চেষ্টা অব্যাহত আছে। চুরির বিষয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে আগামী রবিবার সিআইডি সদর দফতরে সংস্থাটির কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সে বৈঠকে তদন্তের ব্যাপারে একে অপরকে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। সিআইডির সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই টাকা চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। সেদিন থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। বুধবার প্রথম দিনই সিআইডির তদন্তকারী দল বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজীর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করে। এই ডেপুটি গবর্নর মানিলন্ডারিং বিভাগেরও দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পরবর্তীতে তাকে বিষয়টি সম্পর্কে দফায় দফায় আলোচনা করেন সিআইডি কর্মকর্তারা। তাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদও অব্যাহত আছে। তার দেশ ত্যাগের ওপর বাড়তি সর্তকর্তা রয়েছে। তিনি কঠোর নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। টাকা চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব শাখা ও কর্মকর্তারা যুক্ত তাদের নামের তালিকা করা হয়েছে। তাদের দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তাদের ডাকা মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি সদর দফতরে বা সিআইডির তদন্তকারী সংস্থার কাছে হাজির হতে আদেশ জারি করা হয়েছে। ছুটি বাতিল করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের। জানা গেছে, শুধুমাত্র মনিটরিংয়ের অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে টাকা লুটের ঘটনাটি ঘটায় হ্যাকাররা। শুক্রবার পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটারের মধ্যে ৫০টির ডাটা ক্লোন করে নিয়েছে সিআইডি। তাতে হাজার হাজার ডাটা রয়েছে। ক্লোন করা তথ্য যাচাই বাছাই করার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শুক্রবার তদন্ত কমিটিতে আরও পাঁচজন সিআইডি কর্মকর্তাকে যুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটিতে প্রযুক্তি বিষয়ে পারদর্শী ২৫ জন সিআইডি কর্মকর্তাকে যুক্ত করা হলো। সিআইডির একটি দল সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে ওই সার্ভার রুমের দায়িত্বশীলদের গতিবিধি পর্যালোচনা করছেন। বিশেষভাবে গতিবিধি পর্যালোচনা করা হচ্ছে সার্ভার রুমের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ২২ জন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের। সবমিলিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত শতাধিক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই সিআইডির কাছে আটককৃত অবস্থায় রয়েছে। আটককৃতদের অধিকাংশই কোন না কোনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত। আটককৃতদের মধ্যে বিশেষভাবে নজরদারিতে রয়েছে গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কম্পিউটারের সার্ভার স্টেশনে দায়িত্ব পালনকারী আইটি বিশেষজ্ঞরা। এই স্টেশনটি থেকে চব্বিশ ঘণ্টাই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ছিল। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ৮শ’ কোটি টাকা চুরি করে নিয়ে যায় হ্যাকাররা। টাকাগুলো ৫টি মেসেজের মাধ্যমে ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) স্থানান্তরিত হয়। এরপর সোলাইরি রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস ম্যানিলা ও মাইডাস হোটেল এ্যান্ড ক্যাসিনোর মাধ্যমে হংকং চলে যায়। ফিলিপিন্সের এন্টি মানিলন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) টাকার চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভারজারা, এনরিকো তিয়োডোরো ভাসকুয়েজ ও উইলিয়াম সো গো ও কাম সিন অং (কিম অং)-কে শনাক্ত করে। এদের মধ্যে লাপাত্তা হয়ে গেছে ব্যবসায়ী কিম অং। সিআইডি সূত্র বলছে, টাকা লুটের সঙ্গে হ্যাকার ছাড়াও অন্তত একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে ব্যাংকটির জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতো নিজের দোষও স্বীকার করেছেন। সন্দেহভাজন ছয়জনকে আইনের আওতায় আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।
×