ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরী তারামন বিবির যোদ্ধা হওয়ার গল্প

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৯ মার্চ ২০১৬

কিশোরী তারামন বিবির যোদ্ধা হওয়ার গল্প

তারামন বিবির শেষ ইচ্ছা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারছেন। এজন্য তিনি ভিষন খুশি। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব প্রাপ্ত এ নারী অনেকদিন ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। গবেষকরা নব্বইয়ের দশকে তাঁকে জনসম্মুখে তুলে আনেন। অসুস্থ তারামন বিবি শেষ ইচ্ছার কথা জানালেন এভাবে, ‘আমি এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে খুশি। হত্যাকারী, ইজ্জত হরণকারী রাজাকার-আলবদর-আলসামশদের ক্ষমা নাই।’ লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটানো এ বীরপ্রতীককে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শঙ্কমাধবপুর গ্রাম থেকে আবিষ্কার করা হয়। অন্যের বাড়িতে কাজ করে খেতে হয়েছে তাঁকে। অনাহার-অর্ধাহারে থাকায় শরীরে নানারোগ বাসা বাঁধে। বছরের বেশিরভাগ সময় কাটে অসুস্থতায়। অসুখের (রোগ) সঙ্গে লড়াই করে চলছে তার জীবন। ইতিহাস গবেষকরা তাঁকে আবিষ্কার করার পর দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। তারামন বিবিকে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা। পুনর্বাসনে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার শঙ্কমাধবপুরে জন্ম নেয়া ১৩/১৪ বছরের কিশোরী সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো, মাছ ধরতো, মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতে ফাই-ফরমাস কেটে চলছিল সময়। এ সময় পাকসেনাদের অত্যাচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। ক্রমে দেশের চারদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। খান সেনারা তখন খুন-হত্যা-ধর্ষণ-লুন্ঠনে মত্ত। তখনও রাজীবপুরে এসে তার ছোঁয়া পড়েনি। পাক হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জে এসময় চালায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। পুড়িয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। সেই তা-বের শিকার সন্তান-স্বামীহারা কয়েকটি পরিবার এসে আশ্রয় নেয় এই অঞ্চলে। তাদের বুক ফাটা কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এসময় তের বছরের এক কিশোরী তাদের কান্না দেখে বুকের মধ্যে ক্ষোভের তাড়না অনুভব করে। মনে মনে এই অন্যায়ের প্রতিবাদে সে ফুঁসে ওঠে। এ সময় তাঁর মামাতো ভাই খলিল ইসলাম মেয়েটির মাকে এসে জানায়, রাজীবপুরে মুক্তিবাহিনী নতুন ক্যাম্প করেছে, সেখানে রান্নার লোক দরকার। তারামন এই কাজ ভাল পারবে। ওকে আমাদের দরকার। তারামনের মা কুলসুম বিবি জানান, এই মাইয়া আমি কার হাতে তুইলা দিমু। সে সময় এগিয়ে এলেন মুক্তিফৌজ কমান্ডার মুহিব হালদার। তিনি তারামনকে ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করলেন। অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা সেই কিশোরী দীপ্ত শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে চলে এল দশগৃহপাড়ায় অবস্থিত আজিত মাস্টারের বাড়িতে। এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প। এখানে এক মন চাল রান্না হতো। এই খাবার তিন ক্যাম্পে চলে যেত। এভাবে কিশোরী তারামনের নতুন সংগ্রামী জীবনের শুরু। কিছুদিন পর ক্যাম্প ছেড়ে রাজীবপুর মুন্সিপাড়া (পশ্চিমে) ইনসাফ আলী মেম্বারের বাড়িতে ২য় ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এরপর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে কোদালকাটি চরে চলে এলো দলটি। তারপর ৪র্থ ক্যাম্প গঠন করা হয় খারুয়ার চরের খালিপাড়ায়। এভাবে সাধারণ এক কিশোরী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। সে রান্না করে, মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় কেঁচে দেয়, তাদের খোঁজ খবর নেয়, অস্ত্র-শস্ত্র এগিয়ে দেয়। আর রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা শুনে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করার শপথ নেয়। ধর্মবাবা মুহিব হালদার যুদ্ধের অবসরে একদিন মেয়েকে ডেকে বললেন, তারামন তোকে অস্ত্র চালানো শেখাতে চাই। শুনে তারামনের মন উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। সে বলল, আমি পারবো! শুরু হল তারামনের জীবনের নতুন অধ্যায়। সে অন্যান্য কাজের ফাঁকে চিনতে শেখে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র। এরপর গুলি চালানো। তারামনের স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যখন সে রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়া শেখে; সেদিন ব্যাথায় বুকটা ঝনঝন করে ওঠে। এরপর সাধারণ কিশোরীর শুরু হলো গোয়েন্দা জীবনের। সে সাঁতরে সোনাভরি নদী পেরিয়ে মুখে কালি মেখে, চুলে ময়লা মেখে চলে যেত পাকসেনাদের ক্যাম্পে। পাগলি সেজে কান্নাকাটি করতো, খাবার চাইতো। আর ফাঁকে ফাঁকে পাকসেনাদের অবস্থান, সংখ্যা, অস্ত্রের খোঁজ-খবর নিত। পাকসেনারা দুর দুর করে তাকে তাড়িয়ে দিত, কখনো বা খাবার ছুঁড়ে দিত। এভাবেই পাকসেনাদের খবরাখবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আনতো সে। মাঝে মধ্যে যুদ্ধেও তাকে নিয়ে যাওয়া হতো। ক্রমে দলে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল তারামন। Ñরাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে
×