ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বীরাঙ্গনাদের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৯ মার্চ ২০১৬

বীরাঙ্গনাদের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী

সিরাজগঞ্জের নারী মুক্তিযোদ্ধা অতি পরিচিত মুখ, মিসেস সাফিনা লোহানী। দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্র অভিনেতা ফতেহ লোহানী, টিভি তারকা ও সাংবাদিক ফজলে লোহানী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক কামাল লোহানী পরিবারের সন্তান সাফিনা লোহানী। পৈত্রিক নিবাস উল্লাপাড়া উপজেলার ছোনতলা গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাহুকা গ্রামের অধিবাসী। সিরাজগঞ্জের প্রবীন সাংবাদিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সহধর্মিণী। সাফিনা লোহানী স্বামী সন্তান নিয়ে বর্তমানে সিরাজগঞ্জ শহরে বসবাস করেন। দুই মেয়ে সুমি, এমি ও এক ছেলে সাম্যর জননী। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সাফিনা লোহানী সদালাপী, সমাজকর্মী। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীতে নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনা মায়েদের সংগঠিত করেছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছেন। নারী মুক্তি আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এখন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দী হয়েছেন। তবে তাঁর মন এখনও আকুতি করে বাইরে বেরিয়ে নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, সামাজিক কাজ করার জন্য। কিন্তু হয়ে ওঠে না। এ জন্য মন ভারাক্রান্ত থাকে বেশিরভাগ সময়ে। সমাজ সচেতন, যে কোন পেশার মানুষ গেলে তাঁর মনে পড়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকি হায়েনাদের বর্বরোচিত নির্যাতনের চিত্র, বীরাঙ্গনা মায়েদের দুঃসহ জীবনযাপন এবং নির্র্যাতিতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার নানা অনুভূতির কথা। তিনি সব কিছুুই এক নাগাড়ে বলতে চান। জানতে চান বিচারাধীন চিহ্নিত রাজাকারদের হালহকিকত। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মাসে দৈনিক জনকণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের তৃণমূলের অজানা ইতিহাস তুলে ধরছে, বিশেষ করে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি পাতা সাজাবে জেনে তিনি আনন্দিত হলেন। সাংবাদিকের সহধর্মিনী হিসেবে তাঁর আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক, ষাটের দশকের ছাত্রনেতাসহ আজ অবধি যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বেশিরভাগই সাফিনা লোহানীকে সংগ্রামী সমাজ সচেতন নারী হিসেবে চেনে। তিনি বলেন উনসত্তরে ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনের সময় সিরাজগঞ্জ রাশিদাজ্জোহা মহিলা কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী থাকা অবস্থায় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা। এরই মধ্যে তিনি বিয়ে করেন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আমিনুল ইসলাম চৌধুুরীকে। একাত্তরের এপ্রিলে সিরাজগঞ্জ শহরে পাকি বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর সাফিনা লোহানী চলে যান গ্রামে শ্বশুরবাড়ি বাহুকায়। তার শ্বশুর আজিজুল ইসলাম চৌধুরী সন্তান সম্ভবা বধূকে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাফিনা লোহানী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর দেবর এবং আশপাশের কিশোর যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দেন। স্বামী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী তো আগেই চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। ইতোমধ্যে সাফিনা লোহানী পুত্র সন্তান প্রসব করেন। সন্তানের বয়স প্রায় দু’মাসের কাছাকাছি তখন তাঁর স্বামী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী সন্তানের মুখ দেখার জন্য বাড়ি এসেছেন। এ সময় পাকি হায়েনার দল বাহুকা গ্রামে ঢুকে ঘেরাও করে। রাতে তাদের বাড়ি আক্রমণ করলে আমিনুল ইসলাম ঘরের মধ্যে অস্ত্র রেখে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাকি হায়েনার দল বাড়িতে প্রবেশ করে। এরই মধ্যে ফাঁক পেয়ে সাফিনা লোহানী শিশু বাচ্চা নিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যান। পেছন বাড়ির বাঁশঝাড় জঙ্গল এবং ছোট্ট নদী পার হতে গিয়ে তাঁর সন্তান পানিতে পড়ে যায়। পরে অবশ্য সন্তান উদ্ধার করা হয়। এরই মধ্যে পাকি হায়েনারা গোটা বাহুকা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। নারী-পুরুষের চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সে এক ভয়ঙ্কর রাত। সে রাতের কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। এর পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর নানাস্থানে পৌঁছে দিতেন, তাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন। এর মধ্যে খবর আসে, তাঁর স্বামী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তখন তিনি নেমে পড়েন স্বামীসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার কাজে। স্বাধীনতার পর তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে নির্যাতিত নারীদের এবং বীরাঙ্গনা মায়েদের সংগঠিত করে তাদের পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগ করেন। Ñবাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×