ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির

গ্রন্থলোকের আলোকিত মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৮ মার্চ ২০১৬

গ্রন্থলোকের আলোকিত মানুষ

সেই পঞ্চাশের দশকে, স্কুলে আমরা নিচু ক্লাশে, পাঠ্যবই-পুস্তকের সুবাদে তখন রবীন্দ্র-নজরুলের পরে আমাদের প্রিয় কবি-সাহিত্যিক জসীম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। বন্দে আলী মিয়ার শিশুতোষ গল্প, গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ এবং ‘ভাঙা বুক’ ও ‘রূপের নেশা’ নামের দুটি উপন্যাসের কারণে আহমদ পাবলিশিং হাউস নামটি বিশেষভাবে পরিচিত ছিল আমার কাছে। এছাড়া ছিল তাদের প্রকাশিত আবুল মনসুর আহমদের গল্প-উপন্যাস, মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ প্রভৃতি সাড়াজাগানো বই। ‘ইঁচড়ে পাকা’, ‘বইয়ের পোকা’ প্রভৃতি নামে কুখ্যাত ছিলাম ওই বয়সেই, তাই ওসমানিয়া বুক ডিপো, স্টুডেন্ট ওয়েজ, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঈস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, কোহিনূর লাইব্রেরী, বইঘর (চট্টগ্রাম), সাহিত্য কুটির (বগুড়া) প্রভৃতি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামও জানতাম তখন। তবে আহমদ পাবলিশিং হাউসের নাম স্কুল-কলেজ পাঠ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক বইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জানতাম বিশেষভাবে। অবশ্য এর ইতিহাস জেনেছি পরে। তবে প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দীন আহমদকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি আমার, দূর থেকেই তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছেন অনেকে। সৌম্যদর্শন মানুষ। কালো শেরওয়ানি, সাদা পায়জামা, মাথায় টুপি, মুখে ছোট দাড়ি। যাঁরা চিনিয়ে দিয়েছেন তাঁরা সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন তাঁর নাম, বলেছেন তাঁর কীর্তি ও কৃতিত্বের কথা। কেন এই সমীহ সম্ভ্রম বোধ, কে ছিলেন তিনি- এ সব জানতে এই ১৫ মার্চ তাঁর ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের প্রকাশনা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাঁকে স্মরণ করা তাই বিশেষভাবে জরুরি। মহিউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বর গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর বই পড়া ও জ্ঞান আহরণের প্রবল ঝোঁক। ওই আকর্ষণের কারণেই তিনি চাকরি নেন কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত বইয়ের দোকানে। ওই চাকরিতে থাকতেই, ১৯৩৮ সালে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন বই প্রকাশে আত্মনিয়োগ করার। মূলত দেশ জাতি সমাজের কল্যাণে জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দিকটি মনে রেখেই ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বসিরহাট বুক ডিপো’। এরপর কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ১৯৪৫ সালে ঢাকার ইসলামপুর রোডে স্থাপন করেন ‘মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরী’। ওখানে থেকেই কবি গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘নওবাহার’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৫ সালে। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। ১৯৪৯ সালে কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যৌথ মালিকানা ছেড়ে দিয়ে মহিউদ্দীন আহমদ নিজেই ইসলামপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা বুক ডিপো’। ১৯৫৬ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘আহমদ পাবলিশিং হাউস’। প্রথম দিকে গ্লোব, চার্ট, ম্যাপ প্রভৃতিসহ বিভিন্ন শিক্ষা-উপকরণ ও সামগ্রী প্রকাশের দিকে জোর দিয়েছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের আমদানি নির্ভরতা কমানো। পাশাপাশি প্রকাশ করে চলেন ধর্মীয় চেতনা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ ও জাতি গঠন বিষয়ক বই। ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি শুরু করেন শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই প্রকাশ। কারণ তারাই জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের মাধ্যমেই হবে আগামীর বিনির্মাণ। দেশের প্রকাশনা শিল্পে অবদান রাখায় মহিউদ্দীন আহমদকে ১৯৮৪ সালে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ১৯৮৬ সালে ‘বাংলা একাডেমী সম্মাননা’ দেয়া হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। মহিউদ্দীন আহমদ প্রকাশনা ক্ষেত্রে জাতীয় ভূমিকা পালন করলেও শিকড়ের প্রতি ছিলেন গভীরভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই নিজ এলাকায় বহু জনহিতকর কাজ করে খ্যাতি পেয়েছেন ‘দানবীর’ হিসেবে। তাঁর শৈশবের শিক্ষালয় চিনামুড়া হাইস্কুলের টিনের চালাঘরকে তিনি পাকা ভবনে উন্নীত করেছেন নিজ ব্যয়ে। খানেবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ-পাড়া দাতব্য চিকিৎসালয়, নৈয়াইর মাদরাসার ‘আসিয়া ভবন’, মসজিদ, হাসপাতালে জমি দান, পাঠাগার, ছাত্রাবাস, সড়ক নির্মাণসহ বহু কিছু তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নিরলস কর্মপ্রয়াসে। তবে কেমন ছিলেন তিনি প্রকাশক হিসেবে? সাহিত্যিক মহলে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল ‘লেখকজনের প্রকাশক’ হিসেবে। কেন অমন অভিধা? বিশিষ্ট লেখক এহসান চৌধুরী লিখেছেন, সৎ প্রকাশক হিসেবে জনাব মহিউদ্দীন আহমদের তুলনা ছিল না। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে তিনি পিয়ন মারফত আমাদের রয়্যালিটির টাকা অফিসে পৌঁছে দিয়েছেন। এজন্য তাকে কোন তাগাদা দিতে হয়নি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমার ৫০টির অধিক বই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু এভাবে কোন প্রকাশকই টাকা পৌঁছে দেননি। বিশিষ্ট প্রকাশনা-ব্যক্তিত্ব বদিউদ্দিন নাজির লিখেছেন, কবি বন্দে আলী মিয়ার ছোটদের বইগুলোর তিনি (মহিউদ্দীন আহমদ) প্রকাশক ছিলেন। বন্দে আলী মিয়ার সংসার বেশ বড় ছিল, তাঁর একাধিক স্ত্রী ও অনেক ছেলেমেয়ে ছিল। তাই তাঁর অর্থাভাব লেগেই থাকতো। আমার জানা মতে তিনি হাজী সাহেবের (মহিউদ্দীন আহমদের) কাছে পা-ুলিপি বেচে দিয়ে এককালীন টাকা নিতেন, তা সত্ত্বেও হাজী সাহেব মাঝেমধ্যে তাঁকে অর্থ সাহায্য করতেন। বিশিষ্ট শিশু-সাহিত্যিক আল-কামাল আবদুল ওহাব লিখেছেন, আহমদ পাবলিশিং হাউস কাজে ও কথায় এক যা অধিকাংশ প্রকাশকের নিকট থেকে সহজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমার স্মৃতিতে এখনও অম্লান হয়ে আছে পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের শুরুকে ভিন্ন মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছিলেন মহিউদ্দীন ভাই। ওই দিন বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে সারা বছরের বই বিক্রির হিসাব তৈরি করে রয়্যালিটির চেক হাতে তিনি আসতেন আমার খোঁজে- বাসা পর্যন্ত। শুধু আমার বাসায়ই নয়, শুনেছি তিনি তাঁর প্রধান লেখকদের প্রায় সকলেরই বাসায় যেতেন পহেলা থেকে পাঁচই বৈশাখের মধ্যে। তাঁর পরিচিত প্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের হাতে তুলে দিতেন রয়্যালিটির চেক। এভাবেই তিনি আন্তরিকতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এ দেশের কবি-সাহিত্যিকদের। কবি-সম্পাদক কায়সুল হক লিখেছেন, অনেক সময় দেখা যায় রয়্যালিটি নিয়ে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে। কিন্তু লেখক তাঁর ব্যবহারে ক্ষুণœ হয়েছিলেন এমন খবর আমার জানা নেই। তাঁকেও কোন লেখক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে শুনিনি। কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ লিখেছেন, আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মরহুম আবুল কালাম শামসুদ্দীনের এবং আমার গ্রন্থের প্রকাশক হিসেবে আমার পাওনা রয়েলটির অর্থ তিনি প্রতি বছর কড়ায়-গ-ায় হিসাব কষে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজে আমাদের বাড়িতে এসে নগদ অর্থ কিংবা চেক আমাদের হাতে অর্পণ করেছেন। তাঁর এই ব্যবসায়িক সততা ও সৌজন্য কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’... উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়। এর যথেষ্ট চাহিদা ছিল এবং প্রকাশনাটি ছিল লাভজনক। তিনি (মহিউদ্দীন আহমদ) প্রতি বছর যথাযথ হিসাব সমেত মুনীর চৌধুরীর বাসায় এসে তাঁর হাতে একটা চেক ভরতি খাম তুলে দিতেন।... মহিউদ্দীন সাহেবের আচরণে এমন একটা বিনয়ের ভাব প্রকাশ পেতো যেন খামটা নিয়ে মুনীর চৌধুরী তাঁকে অনুগৃহীত করছেন। মুনীর ভাই আমাকে বলেছিলেন, অন্য কোন প্রকাশকের কাছ থেকে এমন সদ্ব্যবহার তিনি পাননি। পরে তিনি যখন আর নেই, তখনও লিলি ভাবীর কাছে অমনি করে পাওনাটা বুঝিয়ে দিয়ে আসতেন। তিনি নেই, তাঁর মতো একজন লেখক-সুহৃদ প্রকাশকের অভাব আমরা অনুভব করবো সবসময়েই।
×