ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহার

ঘড়ির বাইরের কবি

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৮ মার্চ ২০১৬

ঘড়ির বাইরের কবি

বাংলা কবিতায় রফিক আজাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। রফিক আজাদ শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাটি, প্রকৃতি, প্রেম দ্রোহ স্বপ্ন আর ভালোবাসা ও সুন্দরের আকুতি তার কবিতায় বেজে উঠেছে ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। কবিতার সাধনা ছিল তার সমগ্র জীবনের সাধনা। তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় যারা ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছেন তিনি তাদের একজন। দশক এবং সমসাময়িককালকে ধারণ করেও আধুনিক বাংলা কবিতার বাঁক বদলের সঙ্গে তার নাম যুক্ত হয়েছে স্বমহিমায়, তিনি হয়ে উঠেছেন ভিন্ন স্বর আর ভিন্নমাত্রার কবি। জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে তার জন্ম। পিতা সলিমউদ্দিন খান ছিলেন সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক। মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তারা ছিলেন তিন ভাই-দুই বোন। কিন্তু জন্মের আগেই তিনি হারান বড় ভাই মাওলা ও বোন খুকিকে। মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই অকাল প্রয়াত বড় বোন অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘জীবন’। রফিক আজাদ ‘জীবনের’ই আরেক নাম। শৈশব ও শিক্ষাজীবন তার হাতেখড়ি হয় দেশ ভাগের পরে। প্রথমে ভর্তি হন সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুলে। তার ছোটবেলাটা ছিল কঠিন অনুশাসনের। কোনো স্বাধীনতা ছিল না তার। একাকী স্কুলে যাওয়া-আসাও ছিল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সমবয়সীদের সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ ছিল না। এই একাকিত্ব দেখা দেয় শাপে বর হয়ে। ক্লাস ফাইভে পড়ে ফেলেন সাধুটী স্কুল লাইব্রেরির অধিকাংশ বই। সেখানেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরানী, কপালকু-লা, আনন্দমঠ-এর সঙ্গে পরিচয়। হয়ে ওঠেন বঙ্কিম ভক্ত। স্বাধীনতা না পেলেও তার ভেতরে স্বাধীন সত্তার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই শৈশবেই। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মাত্র তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় ভাষা শহীদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসাই তাকে বাংলা ভাষার অন্যতম এক কবি হিসেবে তৈরি করেছিল। গোয়ার স্বভাবেরও ছিলেন সেই ছোটবেলা থেকেই। ১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় বাবার হাতে মার খেয়ে একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, পিসি সরকারের কাছে জাদু শেখা। ট্রেনেই পরিচয় হয় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে। তিনিই বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠান। কৈশোরে সম্পর্কে দাদা হন দেলু নামে একজনের কাছে লাঠি খেলা শিখতেন। দেলু দাদা খুব আদর করতেন রফিক আজাদকে। লাঠিখেলা ভালোই শিখেছিলেন তিনি। সাঁই সাঁই করে ঘুরাতেন লাঠি। তার গ্রামের পাশেই মনিদহ গ্রাম। মনিদহ গ্রামের ষাট শতাংশ অধিবাসীই নিম্নশ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়ের। সুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা ইত্যাদি। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই ছিল তার শৈশব আর কৈশোরের বন্ধু। এই মেলামেশা তাকে দিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা বর্জিত উদার দৃষ্টিভঙ্গি। সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করে ভর্তি হলেন কালিহাতি রামগতি শ্রীগোবিন্দ হাই ইংলিশ স্কুলের নবম শ্রেণীতে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন-চার মাইল। এ সময় কালিহাতি সংলগ্ন গ্রাম হামিদপুরের এক দরিদ্র গেরস্তের বাড়িতে পেইংগেস্ট হিসেবে থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। এটা তার জন্য নতুন এক জীবন, নতুন অভিজ্ঞতা। হামিদপুরে আগের মতো আর সেই বিধিনিষেধ নেই। অবাধ স্বাধীনতা। এ সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সহপাঠী মাঈন উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। ক্লাসের ফার্স্টবয় মাঈন উদ্দিনের সাহিত্যপাঠে আগ্রহ ছিল। এই মাঈনই হয়ে ওঠে তার প্রথম গুরু। হামিদপুরে তার সঙ্গে শুরু হয় তুখোড় আড্ডা। তার মুখেই প্রথম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি প্রভৃতি উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হন। মাঈন তাকে আবৃত্তি করে শোনায় রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। সেই কবিতা শুনে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়ে কিশোর রফিক আজাদ। ভেতরে তখন থেকেই বোধহয় জন্ম নেয় কবিসত্তা। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা ও কলেজ জীবন পার করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বাংলা সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৬৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। কর্মজীবন শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার কর্মজীবন। ষাটের দশকের শেষদিকে টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকারের সম্পাদক ছিলেন। বাংলা একাডেমিতে থাকাকালীনই নিজের নাম উহ্য রেখে রোববার পত্রিকাতেও সম্পাদনার কাজ করেছেন। একপর্যায়ে রাগ করে ছেড়ে দেন বাংলা একাডেমির চাকরি। এরপর নানা সেক্টরে কাজ করার সুযোগ হয় তার। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনে। পরিচালক পদে কাজ করেছেন উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নিয়েছেন এবং সবশেষে কাজ করেছেন আমাদের সময় পত্রিকায়। বিবাহিত ও সংসার জীবন আদিলা বকুলকে বিয়ের মাধ্যমে সংসার জীবন শুরু করেন। এই সংসারে তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হন। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি কবি দিলারা হাফিজকে বিয়ে করেন। এ সংসারে তিনি দুই ছেলের জনক হন। তার সন্তানরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনের বড় একটি বিষয়। ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার যুদ্ধ ছিল অস্ত্রহাতে যুদ্ধের মাঠে এবং একই সঙ্গে কলম দিয়ে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ অসম্ভবের পায়ে সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি প্রেমের কবিতাসমগ্র বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে বিরিশিরি পর্ব রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র হৃদয়ের কী বা দোষ কোনো খেদ নেই প্রিয় শাড়িগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১) হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭) আলাওল পুরস্কার (১৯৮১) কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯) ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২) সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯) কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১) কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬) বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭) একুশে পদক (২০১৩) তার কবিতা ও সৃষ্টির জগৎ রফিক আজাদ ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। ষাটের দশকের কবিতাকে চিহ্নিত করা হয় অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, সংশয় নাগরিক ও যুগ যাতনা এবং টানাপোড়েনের দশক হিসেবে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ষাট দশক ও রফিক আজাদ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ষাটের দশক আমাদের সামাজিক অঙ্গনে এসেছিল আশীর্বাদ ও অভিশাপ নিয়ে। একদিকে বিত্তের বিপুল সম্ভাবনায় স্পন্দিত হয়েছিল সমাজ জীবনের চৌহদ্দি, অন্যদিকে অবারিত সুলভ মুদ্রার দর্পিত প্রবেশ। নতুন সচ্ছলতার সঙ্গে নতুন ও অপ্রতিহত পাপ বয়ে এনেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সুকুমার মূল্যবোধের ওপর হাত রেখেছিল আততায়ী অবক্ষয়। ঐশ্বর্যের আস্ফালনে, স্থূলতার দম্ভে আপাতরকমের ফেনিল বন্দনায়, ক্লেদে ও কদর্যতায় ষাটের দশক একদিকে যেমন আবিল, ঠিক তেমনি, ওই সময়কার অধঃপতনের ক্রন্দনে, আত্মক্লেদের গ্লানিতে, নৈরাশ্যে ও নিঃস্বতায় বেদনাময়। সমাজ জীবনের, এমনি এক পালাবদলের কালে কবিতাঙ্গনে রফিক আজাদের পদপাত।... মূলত ষাটের দশক সময়টা নানা কারণে খুব উল্লেখযোগ্য। যেমন একদিকে চলছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাংচুর। তৈরি হচ্ছে শ্রেণী ভেঙ্গে নতুন শ্রেণী। সমাজ জীবনের এই পালাবদলে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক সঙ্কট, হতাশা, দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ। মধ্যবিত্তকে আক্রান্ত করছে পুঁজি। পুঁজির প্রবল প্রতাপে ভেঙ্গে যাচ্ছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রাচীর। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্য, পশ্চিমের সাহিত্যের হাওয়া এসে লেগেছে বাংলা সাহিত্য মহলে। অনূদিত হয়ে হাতে আসছে বিশ্বের নানা ক্লাসিক বই। প্রবল ঝড় তুলেছে আমাদের শিল্পী কবি ও লেখক মহলে। বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদলেয়ার কবিদের ওপর ফেলছে প্রভাব। কবি রফিক আজাদও সে প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি। সময়, কাল ও কালের সংকট, সমকালীন বোধ ও প্রকাশ তার মধ্যেও লক্ষণীয়। সেসময় কলকাতার ‘হাংরি জেনারেশনে’র অনুসরণে ঢাকায় ‘স্যাড জেনারেশন’ নামে কাব্য-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রফিক আজাদ। স্যাড জেনারেশনের ইশতেহারও লিখেছিলেন তিনি। ইংরেজিতে লেখা সেই ইশতেহারের সার সংক্ষেপ হলো, ‘আমরা গতানুগতিকতাবিরোধী, সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, আমাদের একমাত্র বিশ্বস্তবন্ধু সিগারেট, আমাদের রক্তের মধ্যে বিস্ফোরণোন্মুখ ডিনামাইট, (জীবন নিরর্থক জেনে) আমরা নিঃশেষিত, বিব্রত, ক্লান্ত এবং বিষণœ। ষাটের দশক এবং কবি রফিক আজাদ সম্পর্কে ড. আলী রিয়াজ বলেনÑ ‘আমাদের একটা অন্যতম বক্তব্য হচ্ছে, ষাটের দশকের কবিতা বাংলাদেশের সমকালের মর্মবাণীকে ধরতে পারেনি, তাঁদের কবিতার মধ্যে আছে অবক্ষয়ের ছবি। বাংলাদেশের মানুষ যখন এক গৌরবজনক জাগরণের মধ্য দিয়ে গেছে, সেই দশকের কবিরা কেন কেবল হতাশা ও অবক্ষয়ের কথা শোনালেন, তা নিয়ে আমাদের প্রবল ক্ষোভ ছিল। সেই সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে, আমরা কবি হিসেবে রফিক আজাদকেই শনাক্ত করেছিলাম। ষাটের দশকে পশ্চিমের ‘হাংরি জেনারেশন’ তাঁদের যতটা প্রভাবিত করেছে, দেশের মানুষের সংগ্রাম ততটা তাঁদের উজ্জীবিত করেনি। আমরা একে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বলেই চিহ্নিত করেছিলাম। ষাটের দশকের কবিতার যে চারিত্র লক্ষণ, মানসিকতা তা তার প্রথম দিককার কবিতায় সর্বত্র। তবে রফিক আজাদ সেই সময় থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। সুন্দর এবং শিল্পের জগতের কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছেন। তাই প্রবেশ করতে চেয়েছেন শিল্প ও সুন্দরের কারুকার্যময় বন্দরে। খুলতে চেয়েছেন বন্ধ দরজা। ষাটের দশকের কবিতা থেকে ভিন্নপথে হাঁটার জন্য তিনি কতোটা যাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছেন তা বোঝা যায় তার কবিতার দরজা খোলার আকাক্সক্ষা থেকে। এই আর্তি আর এই অবিনাশী আকাক্সক্ষা তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ অসম্ভবের পায়ে থেকেই ছিল- ‘দ্বার খোলো, প্রতিশ্রুত হে প্রিয় দরোজা।’ ... কারুকার্যময় হে দরোজা, তোমার গভীরে আর স্বপ্নের বাস্তবে যাবো পথ দাও, পথ করে দাও, গণিকার মতো গ্রাস করো এই আম-ু আমাকে। নীরন্ধ্র জাহাজ নও, নও মোটে অনুভূতিহীন, দ্বারে এসে পড়ে আছি কনকনে শীতের রাত্রিতে- গ্রীষ্মের রাত্রির মতো উষ্ণতার মর্মে টেনে নাও। (হে দরোজা) এই যে দ্বারে এসে পড়ে থাকা এবং শীতের রাত্রি সময়ের এই শীতলতা, বিবর্ণতা, হতাশার নাগপাশ এ থেকে মুক্তি নিয়ে গ্রীষ্মের উষ্ণতায় যাবার আকুতির মধ্যেই তার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। রফিক আজাদের মধ্যে বিহ্বলতা, স্বপ্ন ঘোর, এক ধরনের নির্লিপ্ততা থাকলেও তিনি সময় এবং সময়ের যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আবেদন থাকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। বরং অনেক বেশিই সম্পৃত্ত ছিলেন। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এবং যুদ্ধ পরবর্তী ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় ‘ভাত দে হারামজাদার মতো’ কবিতা লিখতে পেরেছিলেন, বলতে পেরেছিলেন- অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছাপালা, নদী-নালা, গ্রাম-গঞ্জ ফুটপাত, নর্দমান জলের প্রপাত, চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী, উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি- আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ। ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো। এ কবিতা তাকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। বলা যায় এই কবিতা কবির সামাজিক দায় পরিশোধ করেছে। এমনি অসংখ্য কবিতায় দেখা যায় রাজনৈতিক সচেতনা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য। তাঁর বিখ্যাত কবিতাসমূহের মধ্যে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’, ‘রফিক আজাদের মুক্তি চাই’, ‘চন্দ্রাহত কেরানির রবিবার’, ‘দরকারি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের সুপারিশ’ উল্লেখযোগ্য। অস্থির সময়, সমাজ, রাজনীতি, যুগ যন্ত্রণার মধ্যেও প্রেম তার কবিতার এক প্রধান বিষয়। বলা যায় তার কবিতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক একটি, রাজনৈতিক সচেতনতা আর অন্যটি জীবনের এই সব জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রেম, সুন্দর ও রোমান্টিকতার দিকে যাত্রা। মূলত ভালোবাসার কাছেই আশ্রয় খোঁজা। যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো জীবনের ভুলগুলি; যদি ভালোবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘ পথে তুলে নেবো ঝোলাঝুলি যদি ভালোবাসা পাই শীতের রাতের শেষে মখমল দিন পাবো ষাটের দশকের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কবি সিকদার আমিনুল হক কবি রফিক আজাদের প্রেমের কবিতা নিয়ে লিখেছেন, ‘রফিকের কবিতায় প্রেম ও নারীর প্রসঙ্গ বারবার আসে, প্রতিশ্রুতি মুক্তির অপরিমিত আলো নিয়ে। তাই তিনি স্বভাবতই নারীকে বলতে পারেন, ‘তোমার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মুহূর্তেই লেখা হয়/কবিতার ব্যবহার্য সমস্ত ছন্দের মূলসূত্র।’ তিনি প্রেমকে প্রচলিত আধুনিক নিয়মে ব্যঙ্গ করেননি- বঞ্চিত অবস্থায়ও বিষণœ ও আন্তরিক সশ্রদ্ধ থেকেছেন। প্রেমের সফলতা বা পূর্ণতার দিকে সোচ্চার হতে তিনি পারেননি- এক মেদুর হতাশা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখেছেন মাত্র। ভালোবাসার এক সরল সংজ্ঞা দেখা যায় তার কবিতায়Ñ ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,/ পরস্পরকে হƒদয়ের কাছে টানা;/ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,/বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;/ ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি/ খুব করে ঝুঁকে থাকা;/ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি,/বৃষ্টির একটানা ভেতরে-বাহিরে/দু’জনের হেঁটে যাওয়া;/ভালোবাসা মানে ঠা-া কফির/ পেয়াালা সামনে/অবিরল কথা বলা;/ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-/যাওয়া কথার পরেও/মুখোমুখি বসে থাকা। [ভালোবাসার সংজ্ঞা : রফিক আজাদ] এই সরল নিরাভরণ সংজ্ঞার পাশাপাশি রফিক আজাদের কাছে ভালোবাসা আবার নানাভাবে বিশ্লেষিত সমুদ্র অনেক দূরে, নগরের ধারে-কাছে নেই;/চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।/রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালোবাসাবাসি;/এখন পাব না আর সুস্থতার আকাক্সক্ষার খেই। (নগর ধ্বংসের আগে) ভালোবেসে এক ফ্রগম্যান চোখের গভীর জলে/লাফ দিয়ে পড়ে; বিন্যস্ত বাগানে কেউ/শতায়ু বৃক্ষের গায়ে ছুরির ফলায়/দীর্ঘসূত্রী হাহাকার রেখে যেতে চায়। (সুন্দরের দিকে চোখ রেখে) ভালোবাসার এইসব সংজ্ঞা ভালোবাসার কাছে আশ্রয় খুঁজে চলা বোহেমিয়ান জীবনে নারী রফিক আজাদের কাছে আবার এক বিস্ময়, গভীর ও নিবিড়ভাবে আবিষ্কারের বিষয়। সেখানে নারী তার কাছে নানারূপে আবির্ভূত সৃষ্টির লয় অথবা ক্ষয়, সুন্দরের ঠিকানা, বিশ্বাস রাখা ও নির্ভর করার আদি ঠিকানা কখনো আবার প্রয়োজনীয় এক মৌলিক গ্রন্থ। “আমার নিকট তুমি এক মূর্তিমান অভিধান খুচরো অথবা খুব দরকারি ভারী শব্দাবলি টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে নিষ্ঠাভারে যে-রকমভাবে দেখে নিতে হয়, প্রয়োজনে তোমাকে তেমনি পড়ি। তুমিই আমার হও বিশ্বাস-স্থাপনযোগ্য সেই বিশুদ্ধ মৌলিক গ্রন্থ; তোমাকে পড়েই শিখে নিই শব্দের সঠিক অর্থ, মূল ধাতু, নির্ভুল বানান। তোমাকে দেখেই জেনে নিই কোন ঠিকানায় আছে সুন্দরের ঘরদোর- বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধে কী কী অস্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন, তাও জানা হয়। (চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া) ভালোবাসা প্রেম কিংবা কাম নিয়ে তার স্বপ্নাচ্ছন্ন ভালোলাগা, সৃষ্টির আকাক্সক্ষা অথবা যন্ত্রণা তিনি তাঁর আরাধ্য নারীর মধ্যে দেখতে চান। তাই তার জন্যই তার প্রতীক্ষা, প্রিয় নারীর জন্যই তার ধ্যানমগ্নতাÑ তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে.. তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে, আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনাথ তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে তুমুল তোলপাড় হৃদয়ে সর্বদা (তোমার কথা ভেবে) খ-িত ব্রিজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই নীরবে দাঁড়িয়ে আছি : আমার অন্ধতা ছাড়া আর কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে; উপেক্ষা করো না তবু, রানী.. তোমার অনুপস্থিতি করুণ, বেদনাময়... বড় বেশি মারাত্মক বাজে রোশনা বালুকা-বেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে; অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে... সুন্দর শাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে... ‘যাই’ [মাধবী এসেই বলে যাই ] নারীকে আবার তিনি দেখেছেন অন্যভাবে অন্য দৃষ্টিতে। তার মধ্যে জেগেছে পিতার চিরন্তন মায়া আর ¯েœহÑ ঐ যে ফর্সা মেয়েটি/গ্রীষ্মে মধ্য দুপুরের মতো গনগনে যার রঙ/রূপের আগুনে পুড়তে-চাওয়া মানুষের আরাধ্যা সে/যার দুটি চোখ থেকে/ বেরিয়ে আসছে গলিত তামা ও দস্তা, লাভাস্রোত,/আমি ঐ মেয়েটির বাবা; (আমার গর্ভে, আমারই ঔরসে) রফিক আজাদ সকল জরা ক্লান্তি নাগরিক ক্ষোভ, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতার মধ্যে দাঁড়িয়েও সুন্দরের প্রতি ছিল তার পক্ষপাত। সুন্দরের দিকে চোখ রেখে অনন্ত ঝর্ণার জলে বনকে বিন্যস্ত করে তবেই উদ্যান, না-হলে তো বন সে শুধু-ই প্রকৃতি। শুধু সুন্দরের দিকে পক্ষপাত বা সুন্দরের সাধনা নয় রফিক আজাদ একজন আশাবাদী কবিও ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতায় আমরা দেখি সেই আশাবাদ ‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে। চুনিয়া বিশ্বাস করে : শেষাবধি মানুষেরা হিংসা- দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।’ (চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া) মাটি, মানুষ, প্রকৃতি ও প্রেম, রোমান্টিকতা, দ্রোহ এবং অন্তঃক্ষরণ তার কবিতাকে দিয়েছে ভিন্নস্বর ও ভিন্নব্যঞ্জনা। তার কবিতায় দেখা যায় মাটির টান ও ঐতিহ্যের প্রতি প্রেম ও মুগ্ধতা- ‘গান হতে বলি আজ দীর্ঘশ্বাসগুলোকে আমার/ সম্পূর্ণ লোকজ গীতি-ভাওয়াইয়া কিংবা ভাটিয়ালি-/দেশজ, ঐতিহ্যময়, লোকায়ত গীতিকার মতো।’ রফিক আজাদের শেকড় এই মাটি আর এই দেশ। ‘আমাকে খুঁজো না বৃথা’ কবিতায় তার ষ্পষ্ট উচ্চারণ- আমাকে খুঁজো না বৃথা কাশ্মীরের স্বচ্ছ ডাল হ্রদে, সুইৎসারল্যান্ডের নয়নলোভন কোনো পর্যটন স্পটে, গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায়ও নয়, খুঁজো না ফরাসি দেশে পারীর কাফেতে, মধ্যরাতে; রাইন বা মাইনের তীরে, সুবিস্তীর্ণ ফলের বাগানে... ... আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ঠেকে আছে পদ্মার ওপর এবং আমার দু’চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে কানায়-কানায় ভরে দিচ্ছে সব ক’টি শুষ্ক নদী, এবং দেখতে পাবে শ্যামল শস্যের মাঠ আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি... (আমাকে খুঁজো না বৃথা) রফিক আজাদ কখনো থেমে থাকেননি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে বির্নিমাণে বিশ্বাসী ছিলেন। নিজেকে আর নানাভাবে কবিতাকে ভাঙচুর করেছেন গ্রহণ আর বর্জনের মধ্য দিয়ে। সম্পূর্ণ বর্জন নয়, গ্রহণে-বর্জনে গড়ে নিই মানুষের বসবাসযোগ্য চিরস্থায়ী ঘর-বাড়ি; রহিরঙ্গে নাগরিক-অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক; স্থানকাল পরিপার্শ্বে নিজ হাতে চাষাবাদ করি সামান্য আপন জমি, বর্গাজমি চষি না কখনো। [অন্তরঙ্গে সবুজ সংসারে] নিজ ভূমিতেই তিনি চাষ করেছেন। দাঁড়িয়েছেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে নিজের মাটি ও কৃষ্টির ওপরে। রফিক আজাদ যা বিশ্বাস করতেন তাই খোলামেলা বলতেন। এজন্য কখনো কখনো তিনি অপ্রিয়ও হয়েছেন অনেকের কাছে। তাই নিজেকে নিয়েই লিখেছেন- হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো, তোমার উদ্ধত আচরণে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দুঃখ পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ, অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার, বলো : মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ, এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন। কবির মৃত্যু ও নতুন জীবন ‘এখনও এপারে আছি, চলে যাব সুতোর ওপারে, সুতোর ওপারে সুখ, সম্ভবত, স্বাধীনতা আছে।’ কবি রফিক আজাদ গত ১২ মার্চ ওপারে চলে গেছেন। দেহগত বিদায় হয়েছে তার। কিন্তু তার সৃষ্টির কোনো মৃত্যু নেই, মৃত্যু নেই তার কবিতার। এক অর্থে নতুন আরেক জীবনে প্রবেশ করেছেন তিনি। চিরদিন ঘড়ির বাইরে থাকতে তো চেয়েছি, বন্ধু, হঠাৎ এমন কী হলো ঘড়ির ভেতরই ঢুকে যেতে হবে এই আমাকেই এখন! বুঝি না জীবনাচার এমনটি হবে ... এতোদিন পরে, জীবন-সায়াহ্নে ঘড়িকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হবে না! তবে কি সময়েরই উদরে অনিবার্য বসবাস? কিন্তু কথা ছিল সময়ের বাইরে থাকার চিরকাল? (ঘড়ির বাইরে, চিরদিন) তার বোহেমিয়ান জীবনে তিনি ঘড়িকে অবজ্ঞা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনো কবিই কালকে অস্বীকার করতে পারে না। রফিক আজাদও তা পারেনি। মাটি মানুষ প্রেম প্রকৃতি এই দেশ, এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ানো ঐশ্বৈর্য থেকে কুড়িয়ে নিয়েছেন প্রাণ আর প্রাণের খোরাক। তাই তার কবিতা মাটির গন্ধে ভরা, পাপ, পুণ্য, বেদনা, বিস্ময় ও আনন্দানুভূতি, যন্ত্রণা, পাপ্তি , অপ্রাপ্তি, ব্যক্তিগত বোধ সমাজ, সমাজ পীড়ন এবং অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা ও কালকে ধারণ করে হয়ে ওঠেছে সবার কবিতা সবার একান্ত অনুভূতি ও নিজেরই একান্ত পাঠ। তাই ঘড়ি অথবা কালকে অস্বীকার করেও কবি রফিক আজাদ কালের কবি, ঘড়ির কবি এবং সেই একই অর্থে কলোত্তীর্ণ কবি ও ঘড়ির বাইরের কবি।
×