ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহী অংশে ধু ধু বালুচর ॥ বালু স্তরে আটকে গেছে নৌকা, চলছে গরু-মহিষের গাড়ি

অপার সৌন্দর্য হারিয়ে পদ্মা যেন এখন রূপ নিয়েছে মরুভূমিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ মার্চ ২০১৬

অপার সৌন্দর্য হারিয়ে পদ্মা যেন এখন রূপ নিয়েছে মরুভূমিতে

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ পদ্মার নৈসর্গিক রূপ নিয়ে কালে কালে অনেক কাব্য হয়েছে। কখনও স্রোতস্বিনী আবার কখনও হাঁটুপানির পদ্মার রূপের গল্প সবার জানা। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে আর পারছে না এককালের প্রমত্ত পদ্মা। জৌলুস হারিয়ে ক্রমেই অচেনা রূপ ধারণ করছে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে তার রূপের তুলনা। তবুও পদ্মা বলে কথা। যুগে যুগে নানা রূপে তার নৈসর্গিকতা ফুটে উঠে। এ পদ্মার বুকেই কখনও চলে পালতোলা নৌকা, আবার পানি শুকিয়ে এ পদ্মা হয়ে যায় বালুকাময় গড়ের মাঠ। নৌকা আটকে তখন চলে গরু-মহিষের গাড়ি। তবুও অপার সৌন্দর্যের পদ্মা সম্ভাবনায় হাতছানি দেয়। রাজশাহীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী এখন পুরোটাই পানিশূন্য। বালুর স্তরে স্তরে আটকে আছে মাঝিদের নৌকা। শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই কাঠ হয়ে গেছে। বিশাল বালুরাশির ওপর দিয়ে এখন চলছে গরু-মহিষের গাড়ি। কয়েক বছর আগেও এ সময়ে পদ্মায় পানি থাকত। তবে তা এখন অতীত স্মৃতি। দিনে দিনে অপার সৌন্দর্য হারিয়ে এখন পদ্মা যেন ঠেকেছে মরুভূমিতে। অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল-বিল ও নদী-নালা। একই সঙ্গে ভূ-গর্ভস্ত পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পদ্মা পানিশূন্য হয়ে পড়ায় গভীর নলকূপেও ঠিকমতো মিলছে না পানি। সেচ ও খাবার পানির সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পদ্মা শুকিয়ে কাঠ হওয়ায় এরই মধ্যে মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সম্প্রতি রাজশাহীর অংশে পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে যেন রূপ পাল্টানো অন্য পদ্মা। কোথাও পানি নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু বালুরাশি। বালুর মধ্যে আটকে পড়েছে মাঝিদের সব নৌকা। ওপারের চরের মানুষ দীর্ঘপথ মাড়িয়ে হেঁটে আসছেন এপারে। ওপারের মালামাল আসছে পদ্মার বুক চিরে গরু-মহিষের গাড়িতে করে। কোথাও কোথাও শিশুদের ক্রিকেট খেলার দৃশ্যও দেখা যায়। ভাবতেই অবাক লাগে পদ্মার বর্তমান সময়ের নিঃসঙ্গতা। তারপরও শুকনো পদ্মা সমানে টানে মানুষকে। পদ্মার এই নিঃসঙ্গ রূপ দেখে অনেকে হতাশ হলেও, অচেনা লাগলেও এই পদ্মাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রাজশাহীর সবকিছু। রাজশাহীতে এলে তাই যে কেউ এক ঢু তো দিতেই চান পদ্মায়। ক্ষণিকের জন্য মন ভাল হলেও পদ্মার অচেনা রূপে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। অনেকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে হায়... পদ্মা। একি তোর রূপ...। তবুও পদ্মা নদীকে ঘিরে এখন আলাদা ঢেউ তারুণ্যের। রাজশাহীর সবকিছুই যেন এখন পদ্মা নদীকে ঘিরে। নদীর প্রবহমান সেই জোয়ার, কলকলিয়ে পানির শব্দ, মাঝিদের গান সবই এখন অতীত। সেই অতীতকে পেছনে ফেলে নদীর কূলে যেন রাজশাহীর বিনোদনের সব স্রোত মিশে একাকার। সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে খানিক রাত অবধি পদ্মা নদীর কূলে মানুষের আনাগোনা থাকে এখনও। বিশেষ করে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ হলে তো আর কথায় নেই। একটানে সোজা কথা ‘চল রে পদ্মার ধারে যাই’। শুকনো হলেও পদ্মার ধারে (তীরে) গেলে যে কারও মন যেন সতেজ হয়ে উঠবে। আনন্দে জলজল করবে চোখ। রাজশাহীর পদ্মা নদীর অন্তত ১০ কিলোমিটারজুড়ে মানুষের কোলাহল লেগেই থাকে। নদীর কলতান না থাকলেও তারুণ্যের কলরব, স্বাচ্ছন্দ্য সবই রয়েছে এখানে। বিশাল জলরাশির পরিবর্তে শুকনো বালুরাশির পাশে খানিকটা আনন্দের ঢেউ। শান্তির সুবাতাস। ভরা পদ্মার প্রতি মানুষের যেমন টান থাকে সর্বক্ষণ, এখন শুকনো পদ্মাও সমানে টানে মানুষকে অজানা আকর্ষণে। শুকিয়ে কাঠ হওয়া পদ্মায় বৃহস্পতিবার বেড়াতে আসা নাটোরের স্কুলশিক্ষক আলী মনসুর জানান, তিনি রাজশাহীতে এলেই একবার পদ্মায় ঢু মারেন। এবার অনেক দিন পর পদ্মায় আসা তার। তবে তার কাছে যেন এখন অচেনা পদ্মা নদী। কয়েক বছর আগেও যে পদ্মার রূপ দেখা যেত এখন তার কিছুই নেই। বালুরাশি ছাড়া একটি নৌকাও চোখে পড়েনি তার। তিনি বলেন, তবুও পদ্মায় বিকেলের চিত্র তার কাছে অনেক সৌন্দর্যের। এতে বিমোহিত হলেও পদ্মাজুড়ে এতটুকু জল দেখতে না পেয়ে হতাশ তিনি। পদ্মার এ চিত্র শুধু রাজশাহী অংশে নয়, নদীর পশ্চিমাংশে গোদাগাড়ী ও পূর্বে চারঘাট-বাঘা উপজেলার ৪০ কিলোমিটারজুড়ে একই অবস্থা। নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় যৌবন হারিয়েছে পদ্মা। স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষা মৌসুমে পানি ভরে থাকলেও নদীর তীরে ভাঙ্গন ও বন্যা দেখা দেয়। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে ছোট-বড় মিলে অসংখ্য চর জেগে উঠে। গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, উপজেলার প্রেমতলী, বিদিরপুর, হরিশংকরপুর ও ভাটোপাড়া এলাকায় বিশাল চর জেগে উঠেছে। কোথাও তেমন পানি নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ায় শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই পদ্মা নদী পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। পদ্মার এমন অবস্থার কারণে চর ও বরেন্দ্র এলাকায় বৈরী আবহাওয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনিভাবে এর বিরূপ প্রভাব কৃষিতে পড়ায় মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মৌসুমের আগেই নদীতে চর জেগে উঠায় মাছের উৎপাদনও কমে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. সারোয়ার জাহান বলেন, উজানের নদীকেন্দ্রিক পরিকল্পনার কারণে পলি জমা হয়ে পদ্মা নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাবে এ অঞ্চলের সব নদী এখন মৃতপ্রায়। পদ্মাসহ এসব নদী সংস্কারে কোন সরকারই পদক্ষেপ নেয়নি। পানির এ সঙ্কট কাটাতে নদীগুলো খননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ও রাজবাড়ীর পাংশায় ব্যারাজ নির্মাণের এখন বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর উৎসস্থল ভারতে। ভারতের নদী অববাহিকাকেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক পরিকল্পনা রয়েছে। পানিকেন্দ্রিক এসব পরিকল্পনা ভারত একের পর এক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তাদের পানিকেন্দ্রিক এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের নদী ও খাল-বিল পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষি, সেচ, মৎস্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, পানি সংরক্ষণের জন্য ভারতের মতো বাংলাদেশেও পানিকেন্দ্রিক বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
×