ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৮ মার্চ ২০১৬

অগ্নিঝরা  মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৮ মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে দেশব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল। একদিকে সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনা। একপর্যায়ে সবাই বুঝতে পারে যে, আলোচনার নামে চলছে সময়ক্ষেপণ। বঙ্গবন্ধু আলোচনাতেই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আলোচনার নামে প্রহসনের অভিযোগ আনেন। তিনি স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছিলেন। একাত্তরের এ দিনেই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম করতে বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় চালিয়ে যেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিলা পরিষদের মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। তাদেরও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী সামরিক ঘাঁটি শক্তিশালী করতে গোপনে গোলাবারুদ আর সৈনিক জড়ো করতে শুরু করেছিল। পাকিস্তানী শাসকরা স্বাধীনতার আন্দোলন দমাতে এভাবে একটু একটু করে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও-মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ ধরনের উস্কানি আর সহ্য করা হবে না।’ একাত্তরের এ দিনে ঢাকার রাজপথ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পদচারণায় প্রকম্পিত ছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য দৃপ্ত শপথগ্রহণ করেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গণমানুষের ঢল নামে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতার বাসভবনে। সহকর্মীদের আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধু বার বার বৈঠক থেকে উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সমবেত বীর বাঙালীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুদের ওপর পাল্টা আঘাত হানো। আজও বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করেন। উনিশ শ’ একাত্তর সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল গণজাগরণের সময়। অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস ছিল ১৮ মার্চ। এ দিনও সরকারী-বেসরকারী ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালতে অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচী সফল করে তোলেন। জনতা সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে অকুণ্ঠ সমর্থন ও একাত্মতা ব্যক্ত করে। জনগণের কণ্ঠে উচ্চারিত সেøাগান ছিলÑ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। জনগণের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা বাঙালী হত্যার প্রয়াস বন্ধ করার আবেদন জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অপর এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান।
×