ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে রাস্তা কাটার উৎসব ॥ নগরবাসী উন্নয়ন ভোগান্তিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ মার্চ ২০১৬

রাজধানীতে রাস্তা কাটার উৎসব ॥ নগরবাসী উন্নয়ন ভোগান্তিতে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘রাস্তা বন্ধ। সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আদেশক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন’। রাজধানীর গুলশান-১ গোল চত্বর মোড়ে এ রকম সাইনবোর্ড দেয়া আছে। সাদা সাইনবোর্ডে লাল কালিতে লেখা এ নির্দেশনা। গোল চত্বরের যে অংশে রাস্তা কাটা হয়েছে সেখানে এখন পর্যন্ত মেরামত হয়নি। রাস্তার ওপর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে স্টিলের পাত। এমন অবস্থা প্রায় মাসাবধি চলছে। এতে নাগরিক দুর্ভোগ হচ্ছে। গুলশান-১ ও দুই নম্বর গোল চত্বর থেকে শুরু করে বনানী এলাকার বেশিরভাগ রাস্তার চিত্র প্রায় একই রকম। সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পক্ষ থেকে চলছে রাস্তা কাটাকাটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীজুড়েই চলছে রাস্তা কাটার উৎসব। ফলে উন্নয়ন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমের আগেই কাজ শেষ করার কথা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোটা রাজধানীই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। সেবা সংস্থাগুলো পরিকল্পিতভাবে কাজ করেনি। তাই প্রতি বছর রাস্তা কাটাকাটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এতে দিন দিন নাগরিক দুর্ভোগ আরও বাড়বে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এসব কাজ করা হবে। ‘রাস্তা বন্ধ। বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করুন’। বনানী এলাকার বিভিন্ন সড়কে এরকম সাইনবোর্ড ঝুলছে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ উন্নয়ন কাজ চলছে ঢিমেতালে। কাজ শেষ করার পর অনেক সড়ক সংস্কার করতে সময় নেয়া হচ্ছে। ফলে কাজ শেষ হলেও রাস্তা ব্যবহারের উপযোগী হচ্ছে না। বনানী ১৮ নম্বর রোডে গিয়ে দেখা গেল, নিয়ন আলোর নিচে চলছে ওয়াসার পাইপ বসানোর কাজ। একইসঙ্গে চলছে রাস্তা সংস্কারও। শ্রমিকরা একদিকে মাটি খুঁড়ছেন, মাটি ভরছেন। আবার ঠিক তেমনি রাস্তার বাড়তি মাটি ট্রাকে তোলা হচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে ঠিকাদার নাসিরউদ্দিন জানান, খোঁড়াখুঁড়ির কাজ যতটা সম্ভব রাতে শেষ করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলেও রাস্তা খুঁড়ে মাটির স্তূপ করা যাবে না। কাজ শেষে রাস্তা পরিচ্ছন্ন করতে হবে, যেন পরদিন সকাল থেকেই স্বাভাবিক যান চলাচল করতে পারে। অনেক সড়কে ড্রেনেজ লাইন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। রাস্তার একপাশে রাখা হয়েছে পাইপ। অন্য পাশে চলছে কাটাকাটির কাজ। মাটি খুঁড়ে বিশাল গর্ত তৈরি করা হয়েছে। কোথাও রেকার দিয়ে পাইপ নামানোর কথা রয়েছে। ছোট গলিতে শ্রমিকরা নিজেরাই রশি দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় পাইপ ড্রেনে নামিয়ে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছেন। শ্রমিকরা বলছেন, উন্নয়ন কাজে কিছুটা হলেও জনদুর্ভোগ বাড়ে। এজন্য কিছুদিন সবাইকে ছাড় দিতে হবে। একবার কাজ হয়ে গেলে দীর্ঘদিন নিরাপদে চলাফেরা করা যাবে। সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে জলাবদ্ধতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্বাচিত মেয়রদের। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছে উন্নয়ন কাজ। যেসব এলাকায় বেশি জলাবদ্ধতা হচ্ছে সেসব এলাকায় পানি প্রবাহের লাইন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। যাতে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়। মহাখালী থেকে আড়ংয়ের রাস্তা দিয়ে এক নম্বর হয়ে গুলশান দুই বা আশপাশের এলাকায় যেতে হলে রাস্তা কাটার চিত্র চোখে পড়বে। তাছাড়া হাতিরঝিল হয়ে গুলশান এভিনিউ কিংবা এক ও দুই নম্বরে গেলেও একই চিত্র। বনানীর রাস্তাগুলোতেও উন্নয়ন ভোগান্তি চোখে পড়বে। মহাখালী, আমতলী কিংবা আশপাশের এলাকাতেও চলছে একযোগে নানা উন্নয়ন কর্মকা-। কোথাও ফুটপাথ উন্নয়ন কোথাও বা ড্রেন সম্প্রসারণ। গুলশান দুই এলাকায় মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার বিপরীত দিকের রাস্তায় চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন ১৫ দিনের বেশি সময় চলছে শুধু রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। রাস্তার একপাশে দেখা গেল বিশাল গর্ত। দিনভর শ্রমিকদের হাকডাক। চলছে মাটি তোলার কাজ। গর্তের গভীরতা অনেক বেশি হওয়ায় কোথাও কোথাও মই দিয়ে মাটি তোলা হচ্ছে ওপরে। রাস্তার অন্য পাশে রাখা হয়েছে পাইপের সারি। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, মাটি কাটার কাজ শেষ হলে পাইপ নিচে নামানো হবে। তারপর বিশেষ ব্যবস্থায় জোড়া লাগানোর কাজ চলবে। এরপর গর্তে ফেলা হবে মাটি। কিন্তু কোথা থেকে সে মাটি বা খোয়া আসবে। জবাবে দিহান নামে এক শ্রমিক জানালেন, গর্তের মাটি নিরাপদ স্থানে রাখা হচ্ছে। আবারও সেখান থেকেই আনা হবে। রাস্তা সংস্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে সংস্কারের কাজ। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার হওয়ার কথাও জানান তিনি। গুলশান এক নম্বরের চিত্রও একই রকমের। তবে শ্রমিকরা জানিয়েছেন, দ্রুতই কাজ শেষ হবে। গুলশান এক থেকে দুই নম্বর যেতেও উন্নয়ন কর্মকা- চলতে দেখা গেছে। সব খানের চিত্রই প্রায় কাছাকাছি। কোথাও কাজ শুরু। কোথাও চলমান। কোথাও শেষের পথে। তবে সব খানের ভোগান্তি চলমান। গাড়ি বা পথচারী যাতায়াতে সমস্যা তো আছেই। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে গাড়ি জটলা। কখনও যানজটও হচ্ছে। তবে রাস্তায় মাটির কোন স্তূপ নেই। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের বিভিন্ন শর্ত দিয়েই কাজ দেয়া হয়েছে। শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো রাস্তায় মাটির স্তূপ থাকতে পারবে না। গুলশান এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাস্তা কাটার আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কিংবা ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে তেমন একটা সমন্বয় হয় না। হঠাৎ করে উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা কাটা হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়। অনেক রাস্তা বন্ধ রাখতে হয়। বিকল্প সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিন হয়। এদিকে বছরের শুরু থেকেই রাজধানীর গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া অংশে চলছে সড়ক সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণের কাজ। এ কাজের জন্য সড়কের অর্ধেক জুড়ে ফেলে রাখা হয়েছে ইটপাথরের খোয়া। মেয়র মোঃ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের অংশে সড়কের অর্ধেকেরও বেশি অংশ কেটে পাইপ বসানো হচ্ছে। সড়কটি দিয়ে একসঙ্গে পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলতে পারে না। ফলে এখানে সারাক্ষণ লেগে থাকে যানজট। শান্তিনগর-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচের অবস্থাও একই। এতে একদিকে যেমন ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী অন্যদিকে নিচের সড়কের অর্ধেকেরও বেশি অংশ কেটে চলছে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপনের কাজ। ফলে সড়কটিতেও লেগে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার বেশিরভাগ সড়কে চলছে উন্নয়ন কাজ। সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি সেবাদানকারী সংস্থা, ঢাকা ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, ডেসকোসহ সড়কের নিচে থাকা অন্যান্য সংস্থার সার্ভিস লাইন ঠিক করতে প্রতিনিয়ত রাস্তা কাটতে হচ্ছে। বিভিন্ন সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবে সব সময়ই নগরীর সড়কে এমন চিত্র দেখা মিলে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, কিছু শর্ত সাপেক্ষে অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সড়ক খননের অনুমতি দিয়ে থাকে সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে জনদুর্ভোগ হয় এমন সময় সড়ক খোঁড়া যাবে না। অনুমতির ২৮ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। প্রধান সড়কগুলোতে সরকারী ছুটির দিন ও রাতের বেলায় কাজ করার বেশি তাগিদও থাকে। কিন্তু তারা এসব নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। আগে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমতি নেয়া হলেও এখন আর তাও নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে জড়িতদের অনেকে নিজেদের ইচ্ছে মতোই কাজ করে যাচ্ছে। জনদুর্ভোগ এড়াতে রাতে সড়ক খোঁড়ার কথা থাকলেও এখন সড়ক খোঁড়া হচ্ছে দিনে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও এসব বিষয়ে তেমন কোন তদারকি হচ্ছে না। মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরা বাজার পর্যন্ত সড়কেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। কমলাপুর, কাকরাইল থেকে ফকিরাপুল সড়কে চলছে ড্রেনেজ পরিষ্কারের কাজ। তাছাড়া একযোগে নগরীর ক্ষতিগ্রস্ত ফুটপাথে চলছে উন্নয়ন কাজও। ফলে যানবাহনের পাশাপাশি পথচারীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এছাড়া মগবাজার, মৌচাকসহ আশপাশের এলাকায়ও এমন চিত্র। ফলে এসব এলাকায় জনভোগান্তি মাত্রা ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি ৩০০ সড়কের তালিকা চূড়ান্ত করেছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। উত্তর সিটিও চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের মেরামত কাজ। দক্ষিণের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোতে জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়েছে। নগরীর এতগুলো সড়কে একযোগে কাজ শুরু হওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর বলেন, উন্নয়ন কাজ তো করতেই হবে। তাই বলে তো রাস্তা সংস্কার বন্ধ রাখা যাবে না। তবে আমরা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে জনদুর্ভোগ যাতে না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রেখে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঠিকাদারদের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনভোগান্তি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা তো রয়েছেই।
×