ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

অবিলম্বে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হোক

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৮ মার্চ ২০১৬

অবিলম্বে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হোক

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য সরকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটা কমিটি গঠন করেছে। এর প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গবর্নর ড. ফরাস উদ্দিন। শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি কী খুঁজে বের করতে সক্ষম হয় এবং তারা কী সুপারিশ করে এর জন্য সম্ভবত দুই-তিন মাস সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে ড. ফরাস উদ্দিন চুরির ঘটনার কথা কাগজে আসার পর তার এক লেখায় পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ঘরের ভেতরের লোকের সম্পৃক্ততা না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এটা ব্যাংকিং খাতে প্রচলিত একটা সাধারণ ধারণা। চুরি-চামারি, জোচ্চোরি, জালিয়াতি ইত্যাদি ব্যাংকে সাধারণত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ঘটে নাÑ এটাই অভিজ্ঞতা। এমতাবস্থায় দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়। তবে আপাতত দেখা যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বড় ঘটনা, তাও বিদেশে রক্ষিত ‘রিজার্ভ’ নিয়ে, তাই পদক্ষেপও বড়। এ ধরনের ত্বরিত পদক্ষেপ আমরা ‘হলমার্ক’, ‘বিসমিল্লাহ’ বা ব্যাসিক ব্যাংকের বেলায় পাইনি, যদিও এসব ঘটনা দেশীয় মানদ-ে বেশ বড়ই ছিল। বহু কালক্ষেপণের পর অবশ্য পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। জানা মতে, মামলা চলছেÑ ফলাফল জানা যাবে পরে। উপস্থিত ক্ষেত্রে গবর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন নৈতিক দায় নিয়ে। এটা একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুইজন সংশ্লিষ্ট ডিপুটি গবর্নরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দুইজন সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালকের চাকরিও যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। ব্যাংকিং সচিবকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগের ব্যাংকিং সচিবকেও একইভাবে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এসব পদক্ষেপে জনমনে একটা স্বস্তি ফিরে আসবে বলে মনে হয়। কিন্তু যে প্রশ্নের শেষ নেই তা হচ্ছে কী করে হ্যাকাররা সিস্টেমের ভেতর ঢুকে এ অভাবনীয় কা-টি ঘটাতে পারল। বিদায়ী-গবর্নর ড. আতিউর বলেছেন, ঘটনাটি ছিল তার কাছে ভূমিকম্পের মতো বা সন্ত্রাসী আক্রমণের মতো। তিনি প্রথমাবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় তদন্ত কমিটির প্রথম কাজ হবে পদ্ধতিগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে ভবিষ্যত কর্মকা- ‘সিকিউর’ করা। ড. আতিউরের অবহেলা এই ঘটনায় কতটুকু দায়ী ছিল তা পরে জানা যাবে। আপাতত আমাদের উৎসাহ জানার যে টাকা গেছে তা উদ্ধার হবে কী না। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু টাকা ফেরত পেতে আমাদের সাহায্য করছে। একটি ইংরেজী দৈনিকে ফিলিপিন্সের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের ওপর একটা স্টোরি পড়ছিলাম। তাতে বার বার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘স্টপ প্যামেন্ট অর্ডার’ ঐ ‘আরসিবিসি’ ব্যাংকে গেছে ৮ ফেব্রুয়ারি। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক ৯ ফেব্রুয়ারিতে ‘স্টপ পেমেন্ট অর্ডার’ অবজ্ঞা করে টাকা দিয়ে দিয়েছে ‘পার্টিকে’। ‘ব্যাংকিং সিস্টেমে’ স্টপ পেমেন্ট একটা মারাত্মক অস্ত্র। যে কোন চেকদাতা চেক দেয়ার পর ‘স্টপ পেমেন্ট অর্ডার’ করতে পারে। ব্যাংকাররা তা ‘চেক পেমেন্ট’ করার আগে পেলে অবশ্যই ‘পেমেন্ট’ বন্ধ করে দেবে। এটাই রীতি। তা করা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কাগজে দেখলাম ‘ফিলিপিন্সের’ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা বার বার ‘সিক্রেসি’র দোহাই দিয়ে কেন ‘স্টপ পেমেন্ট অর্ডার’ পাওয়ার পরও পেমেন্ট করা হলো এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার সমস্ত গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চারটি সন্দেহজনক এ্যাকাউন্ট ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে খোলা হয়েছে। তিনি খোলাখুলি কিছু না বলে ‘ক্যামেরাতে’ সব কথা বলতে চান। ফিলিপিন্সের ব্যাংকের জালিয়াতির শুনানিতে যেসব তথ্য বাংলাদেশের একটি ইংরেজী কাগজে ছাপা হয়েছে, তা পড়ে আমি বুঝতে পারছি টাকা ট্রান্সফারের পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছে ‘আরসিবিসি’ ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভালভাবে এই কেসটি ফলো-আপ করলে ফল আমাদের পক্ষে আসতে বাধ্য। এই জালিয়াতিটি যে মানিলন্ডারিংয়ের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আগেই উল্লেখ করেছি সংশ্লিষ্ট চুরির ঘটনায় কার কী দায়িত্ব, কার কী অবহেলা ইত্যাদি তদন্ত কমিটি খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করবে। আমি এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। আমি কয়েকটি বিষয়ে দু’একটা কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে অনেক কিছু ঘটছে যা টার্গেটভিত্তিক। নির্দেশ এলো এত তারিখের মধ্যে অনলাইন ব্যাংকিং চালু করতে হবে। এ বছরে ‘এসএমই’ ঋণ দিতে এত টাকা। এত তারিখের মধ্যে শাখার মুনাফা করতে হবে দ্বিগুণ। আমানত বাড়াতে হবে তিনগুণ। কৃষিঋণ দিতে হবে এত কোটি টাকা। নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে ১০০ কোটি টাকা। এ ধরনের হাজার প্রকারের টার্গেট আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে, মন্ত্রণালয় থেকে, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে। টার্গেট ভাল, কিন্তু ধারণক্ষমতার বাইরে টার্গেট বিপর্যয় ডেকে আনে। ‘কনজুমার লোন’ দিতে হবে ৫ কোটি টাকার। লোক না পেয়ে ম্যানেজার সাহেব নিজের নামে, বেনামে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের নামে ৫ কোটি বিতরণ করে দিলেন- এ ঘটনা বিরল নয়। আমি যা বলছিলাম তা হচ্ছে সকল ক্ষেত্রে এই তাড়াহুড়া আমাদের দারুণ ক্ষতি করছে। কম্পিউটারায়নে সমস্যা আরও প্রকট। অফিসারদের মধ্যে, বিশেষ করে সরকারী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসারদের মধ্যে প্রচুরসংখ্যক অফিসার কম্পিউটার চালাতেই জানে না। আইটি শিক্ষিত/প্রশিক্ষিত লোকের দারুণ অভাব। দেখা যায়, এই শ্রেণীর কিছু অফিসার এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে যায়। অথচ তাদের সীমিত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা তা করে। তড়িঘড়ি করে কাজ করার প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের সর্বত্র। আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এখন সব কাজ সুসংহত করা (কনসোলিডেট)। সম্প্রসারণের কাজ অনেক হয়েছে। বিভাগের পর বিভাগ খোলা হয়েছে, জেনারেল ম্যানেজার, নির্বাহী পরিচালক ও ডিপুটি গবর্নরের অনেক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পদোন্নতিও খুব সহজ। যা হবার হয়েছে। তাদের উচিত এখন সব কাজে গতি আনা, কাজগুলোকে ‘সিকিউর’ করা। একই করণীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোরও। সামনে খারাপ দিন আসছে বলে আমার অনুমান। খারাপ দিনটি আসবে খেলাপি ও শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ নিয়ে। বাংলাদেশে প্রথমে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পুনঃতফসিলকরণ নীতি ছিল উদার। যতবার ইচ্ছা ততবার পুনঃতফসিল করা যেত। পরে তা হঠাৎ করে তিনবারে সীমিত করা হয়। বলা হয়, তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। এই বাধ্যবাধকতা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করা শুরু করে। পরে নিয়ম করা হয় লোন রিস্ট্রাকচারিংয়ের। অর্থাৎ ঋণ পুনর্গঠন। এর আওতায় বড় বড় ঋণগ্রহীতার সুদের হার কমানো হয়। ঋণের টাকা ফেরত দিতে গ্রেস পিরিয়ড করা হয়। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়। এছাড়া আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা বড় বড় গ্রাহকের দেয়া হয় যা নিয়ে ছোট ছোট গ্রাহকের মধ্যে অসন্তোষ আছে। আমার ধারণা, বর্তমান বিশ্ব মন্দা অব্যাহত থাকলে, চীনের অর্থনীতির অধঃগতি অব্যাহত থাকলে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের মূল্য মন্দাজনিত কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা অব্যাহত থাকলে আমাদের বড় বড় ক্লায়েন্টেরও নানা অসুবিধা দেখা দেবে। তাদের অনেকেরই ঋণের পরিমাণ বেশি। যত ‘ক্যাশ’ তারা ‘জেনারেট’ করতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি তাদের ঋণের দায়। একসময় তাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ভেঙ্গে পড়বে। এটি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বনাশ হবে, ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশ হবে। এ ব্যাপারে কী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সজাগ আছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এখন আন্তর্মুখী হওয়া। সিস্টেম, মেথডগুলো রিভাইজ করা। সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে সংহত করা। নিজেদের কাজ মনিটর করার গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের কাজের ওপর মনিটরিং বাড়ানো দরকার জরুরী ভিত্তিতে। সবার মধ্যেই এখন বড় বড় কাজ করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে ছোট ছোট কাজ অবহেলিত হচ্ছে। অথচ ছোট ছোট কাজ কোনভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দুইদিন আগে সমস্যা হয়ে গেল এটিএম বুথ নিয়ে, পরে ঘটল রিজার্ভ হ্যাকিং। এসব ‘সিগন্যাল’। আমি মনে করি, এসব ঘটনায় আমাদের জন্য বড় শিক্ষাই হয়েছে। তা না হলে আমরা ‘কনসোলিডেশনের’ কথা ভাবতাম না। ‘সিকিউরিটির’ কথা ভাবতাম না। ভাল করছি কী মন্দ করছি তা নিয়ে ভাবতাম না। এবার অবশ্য সুযোগ এসেছে আত্মশুদ্ধির, আত্মপরীক্ষার। বিদায়ী গবর্নর যা রেখে গেছেন তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক। নতুন গবর্নর ফজলে কবির আসছেন। তিনি সজ্জন ব্যক্তি, প্রয়োজনীয় মেধা ও দক্ষতা তার আছে। আমি নিশ্চিত তিনি হাল ধরতে পারবেন। ইতোমধ্যে সরকারের উচিত অঙ্গীকার মোতাবেক ‘ব্যাংকিং কমিশন’ গঠন করে ফেলা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা, বাণিজ্যিক ব্যাংকের দুর্বলতা, সমস্যা অবিলম্বে চিহ্নিত করা হোক। এই খাতে বহু ময়লা জমেছে। এটা কেউ দেখছে না। দেখা দরকার। শত হোক রিজার্ভ হ্যাকিংয়ে যদি হাজার কোটি টাকা গিয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু ‘ময়লা’তে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে হাজার হাজার কোটি টাকা। এখনই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×