ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৮ মার্চ ২০১৬

অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

(১৭ মার্চ সম্পাদকীয় পাতার পর) কমান্ডো অভিযানে এ সাফল্যের ফলে মুক্তি সংগ্রামকে নতুনতর পর্যায়ে কমান্ডো অভিযান হতে গেরিলা যুদ্ধের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এ সময়ে শুধু নিচের তলায় নয়, ওপর তলায় যে স্থান হতে সামগ্রিক মুক্তি সংগ্রামের রণনীতি ও রণ-কৌশল পরিচালিত হচ্ছে, সে স্থানে, সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সুসমন্বিত ঐক্যবদ্ধ প্রয়োজন। এ সংখ্যা থেকে জানা যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে বাংলাদেশ নিয়মিত সেনাবাহিনীর প্রথম অধিনায়কগণের বিদায়ী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অভিবাদন গ্রহণকালে রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলেন, “আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা কিছুতেই সম্ভব নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের পা চাটা-দালাল ইয়াহিয়ার কসাই বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারে।” বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ঘোষণা করেন “আপোস নয় সংগ্রাম’ চলবে আপোস নয় সংগ্রাম গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “হানাদার সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্ভব। আপোসের মাধ্যমে নয়, সংগ্রামের দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।” মুজিব নগরে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী রমেশচন্দ্রের সঙ্গে এক ঘরোয়া সাক্ষাতে তিনি আরও বলেন যে, ওয়ালী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীগণ আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রাম চালাচ্ছেন। ‘মুক্তিবাহিনী সমাচার’ এ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের কথা তুলে ধরা হয়েছে “বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ রণাঙ্গন থেকে মুক্তিবাহিনীর বিরাট সাফল্যের সংবাদ জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে তাদের শক্তিকে সুসংহত করে, হানাদার বাহিনীর ওপর চরম আঘাত হানছে। সরকারী সূত্রের এক গোপন খবরে প্রকাশ বাংলাদেশের ৯৭টি থানা এখন মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ দখলে রয়েছে। বাংলার বীর সৈনিকরা এসব অঞ্চলে তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকা শহরেও মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গত ১০ অক্টোবর রাতে মর্টার আক্রমণ। এ আক্রমণে ক্যান্টনমেন্ট এবং মহাখালীর অনেক সরকারী কার্যালয়ের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এছাড়া দয়াগঞ্জ, টিকাটুলি, ধানম-ি, যাত্রাবাড়ী প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিবাহিনী যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। মুক্তি বাহিনীর এক আক্রমণে মেডিক্যাল কলেজে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। রায়পুরায় এক আক্রমণে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩৫ জন খান সেনাকে হত্যা করে। টাঙ্গাইল থেকেও মুক্তিবাহিনীর সফলতার খবর এসেছে। এর মধ্যে নাগরপুরে এক হামলায় ৪০ জন খান সেনাকে নিহত করে। বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, নোয়াখালীর ফেনী অঞ্চল কার্যত মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। এছাড়া সমস্ত নোয়াখালীতে তুমুল লড়াই চলছে। কুমিল্লাতে খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। বাঞ্ছারামপুর, মুরাদনগর, নবীনগরে লড়াই চলছে। সরাইলের এক সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৩ জন হানাদার নিহত হয়। ফরিদপুরেও একই অবস্থা। জিরকা প্রভৃতি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। বরিশাল, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলাতেও মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করছে। ময়মনসিংহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লড়াই চলছে। খান সেনা ও দালালদের খতম করছে। মোদ্দাকথা মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ রণাঙ্গনে তাদের শক্তিকে সুসংগঠিত করছে। যার ফলে হানাদার বাহিনী এসেই বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর মুক্তিবাহিনী ইত্যবসরে তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করে দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।” মানুষজনকে উদ্দীপ্ত করার জন্য ও সাহস যোগাবার জন্য যশোরের একটি ঘটনার বর্ণনা করে চাষীর কোদাল! “আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে যশোহর জেলার নেহালপুর গ্রামের জনৈক বীর চাষী কোদালের আঘাতে একজন পাক সেনাকে খতম করে। পশ্চিম সেক্টরে কর্মরত জনৈক ন্যাপ কর্মীর খবরে প্রকাশ ঐ দিন একদল পাক সেনা উক্ত গ্রাম আক্রমণ করে। ইসলামের প্রতিনিধি জনৈক পাক সেনা জনৈকা যুবতীকে ধরার জন্য দৌড়াতে থাকে। যুবতী দৌঁড়ে মাঠে চলে যায়। ঐ সময় মাঠে কয়েকজন কৃষক কোদাল দিয়ে কাজ করছিল। তারা যুবতীটির অসহায় অবস্থা দর্শনে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে একজন সাহস করে এগিয়ে এসে ঐ শয়তান সৈন্যটিকে কোদাল দ্বারা আঘাত করে তাকে আজরাইলের হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়।” এ সংখ্যায় দু’টি সেøাগান ছাপা হয় “স্বাধীন ও নতুন বাংলা গড়িয়া তুলুন” “স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”। এ সংখ্যায় ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়- পঞ্চম সংখ্যা থেকে স্বাধীনতা নতুন নামে বেরুবে। নতুন নাম প্রতিরোধ। খোদাদাদ জানিয়েছেন, স্বাধীনতার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের অনেককে অনেকে চিনে ফেলছিলেন। সে কারণে নাম বদলের সিদ্ধান্ত হয়। খোদাদাদের মতে প্রতিরোধ-এর দু’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ-সপ্তম (যুগ্ম) সংখ্যা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বর্ণনা অনুযায়ী অনুমান করছি বিজয় দিবসের ঠিক আগে আরেকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। অষ্টম সংখ্যা। সেই সংখ্যার সম্পাদকীয়টি তিনি উদ্ধৃত করেছিলেন। ॥ নয় ॥ পঞ্চম সংখ্যাটি পাইনি। সুতরাং এর বিষয়গুলো জানা যাচ্ছে না। তবে, আমার কাগজপত্রের মধ্যে একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। খুব সম্ভব তা পঞ্চম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। সম্পাদকের পেন্সিল মার্ক দেখে অনুমান। না ছাপা হলেও প্রতিবেদনটি তুলে দিচ্ছি। কারণ এই বিবরণে কোনো অতিরঞ্জন নেই। সেই সময় যা ঘটেছে, যা জেনেছেন তারই বৃত্তান্ত। পাকিস্তানের সামরিক সরকার যখন বিশ্ববাসীকে প্রাণপণ চেষ্টায় বুঝাতে চাচ্ছেন যে, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা শুধু কিছু সংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদীকে দমন আর তাছাড়া পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক তখনই উদ্ঘাটিত হলো অত্যাচার ও ধ্বংসের একটি মর্মন্তুদ চিত্র। গত ১৭ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার অপর পারে পর পর চৌদ্দটি গ্রামে পাক ফৌজের সহায়তায় রাজাকার, অবাঙালী, মুসলিম লীগ ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থন-পুষ্ট গুণ্ডাবাহিনী মানবজাতির ইতিহাসে এক ন্যক্কারজনক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের আর একটি অধ্যায়ের সংযোজন করল। (১) নান্দাইল (২) রুইতপুর (৩) শিবরামপুর (৪) সৈয়দপুর (৫) কামর খাঁ (৬) গোয়ালখালি (৭) গাটাগাঁও (৮) আটি, (৯) গাছগাঁও (১০) মোরাজীগাঁও (১১) রুহিলা (১২) খলমা (১৩) কামরাঙ্গীর চর (১৪) খোলামরা এই গ্রামগুলো প্রকারান্তরে বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে ধলেশ্বরী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রত্যেকটিই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই সমস্ত গ্রামে ১৬ নভেম্বরের রাত থেকে সামরিক সরকারের আদেশে এই পৈশাচিক হত্যালীলা শুরু হয়। ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনদিন এবং তিনরাত উপরোক্ত গ্রামগুলোতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিচারে গ্রামবাসীদের হত্যা করা হয়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ সশস্ত্র পাক ফৌজ ও রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে এই গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায় এবং অবাঙালী মুসলিমলীগ, ও ইসলামপন্থী দলগুলোর লোকেরা ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং ভীত সস্ত্রস্ত গ্রামবাসী যখন পালাতে চেষ্টা করেছে তখন তাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। যারা ঘরের ভিতরে লুকিয়ে ছিল তাদের বাইরে টেনে বের করে এনে মারা হয়। মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার এই যে, ইসলামপন্থী দলের লোকেরা যারা কথায় কথায় ইসলাম ধর্মের শাসন-অনুশাসনের উল্লেখ করে তারাই এই নারী নির্যাতনে বেশি অংশগ্রহণ করে। আনুমানিক এক হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং ছয়শত বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। তাছাড়া আহতের সংখ্যাও হাজার খানেক হবে। এই সকল গ্রামগুলোর অধিবাসীরা প্রায় সবাই ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। ঢাকা শহরের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় প্রায় অধিবাসীরাই শিক্ষিত এবং সচ্ছল। রুইতপুর ও শিবরামপুরের বাজার দুটি এ অঞ্চলের তথা পূর্ব বাংলার দুটি বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে প্রস্তুত লুঙ্গির চাহিদা বাবুরহাটের লুঙ্গির মতো বাংলার সর্বত্র। এই বাজার দুটির সমস্ত দোকানপাট, বিক্রয় কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ধ্বংসলীলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আটি এবং কামরাঙ্গীরচর গ্রাম দুটি। কেবল আটিতেই তিন শত জন হতাহত হয়েছে এবং দুই শত গৃহ ভূমিসাত করা হয়েছে। এই সমস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে আটি ছিল সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সেখানে নির্বিচারে রাজাকারদের বাহিনী পাকফৌজের সহায়তায় অকথ্য অত্যাচার চালায়। চলবে...
×