ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে প্রয়োজন সৎ মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৮ মার্চ ২০১৬

রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে প্রয়োজন সৎ মানুষ

(শেষাংশ) ২০০৭ সালের ২২ আগস্ট সকাল ১১ টায় ডিজিএফ-আইর ব্রিগেডিয়ার আমিনের নেতৃত্বে পাঁচজন সেনা কর্মকর্তা ফুলার রোডের টাওয়ার ভবনে এসেছিলেন আমি, অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে আলোচনা করতে। তিন ঘণ্টাব্যাপী সে আলোচনায় আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম, অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করে অনতিবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে। আমার সেই বক্তব্যকে হঠকারী বলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন উপস্থিত এক সহকর্মী। তাঁর বিবেচনা হয়ত মিথ্যা ছিল না। সেই দিন রাত বারটার পরপর যৌথ বাহিনী হানা দিয়েছিল টাওয়ার ভবনে। আমাকে ও সেই সহকর্মী অধ্যাপক হারুনকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল ডিজিএফআই সেলে। ১২ দিনের রিমান্ডসহ ৫ মাসের দুঃসহ কারাজীবনকালে সিএমএম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছিলাম, তাকেও সহবন্দী শিক্ষকগণ হঠকারী বলেছিলেন। সম্ভবত উপরে বর্ণিত কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আমাকে আস্থায় নিতে পেরেছিলেন। নীল দলের প্রার্থী হয়ে আমি জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির দু’বছরের সাধারণ সম্পাদক এবং পরপর দু’বার সভাপতি নির্বাচিত হই। নীল দলে আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করি। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একাংশের প্রবল বিরোধিতার মুখেও সর্বোচ্চ আদালতের আইনী সহায়তায় সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে হঠকারী আখ্যা দিয়েছেন অনেকে। ২০১৩ সালে সরকারের সঙ্গে পূর্ব আলোচনা ছাড়া জাকসু নির্বাচন দেয়াকে হঠকারী আখ্যায়িত করেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি নির্বাচিত উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগকে হঠকারী বলেছেন নিকটজনেরা। ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে শুরু হওয়া গণজাগরণে আমি শুরু থেকেই যোগ দিয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে থেকে আমার এভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে গণজাগরণে অংশ নেয়াকে কিছু শিক্ষক হটকারী বলেছেন শুধু নয়, রাতের অন্ধকারে জামায়েত-শিবিরের জঙ্গীরা উপাচার্য ভবন আক্রমণ করেছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। জীবনে এত হঠকারী সিদ্ধান্তের পরও আমার চেতনা ও লক্ষ্যে আমি এখনও একজন বিপ্লবীই রয়ে গেছি। জীবনে বড় অর্জন তেমন কিছু নেই, তাতে আমার কোন খেদও নেই। আমি পরিপূর্ণভাবে সুখী মানুষ। আমি আমার স্বপ্নগুলোকে গভীর যতেœ হৃদয়ের গভীরে লালন করে যাচ্ছি। জীবনের পরিণত বয়সের এই ক্ষণে জাসদে যোগদান যদি হঠকারী হিসেবে চিত্রিতও হয়, তাতে আমি বিচলিত হবো না। অতীতের আপাতদৃষ্টিতে হঠকারী কোন সিদ্ধান্তকেই হঠকারী বলে মনে করি না, কারণ আমার নেয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল আমার মনে এবং হৃদয়ে ধারণ করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিতে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তির খুব বেশি প্রয়োজন আজ। তা অর্জনে দরকার সাহসী, সময়োপযোগী ও নিঃস্বার্থ সিদ্ধান্তের। তাহের ভাই বলতেন, ‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোন সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।’ তাহের ভাইয়ের ডাকে নিঃশঙ্ক চিত্ত অর্জনের পথ ধরে হাঁটছি বহু বছর, কিছু পথ এখনও বাকি আছে। নিঃশঙ্ক চিত্ত অর্জন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, তাহেরের মতো মহাপ্রাণেরা। তাঁরা বাংলাদেশের ভিত্তি হিসেবে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ চেয়েছিলেন, যে সমাজে মতপার্থক্য থাকলেও মানুষ মানুষের চিন্তার ভিন্নতাকে সম্মান করবে। এমন একটি আলোকিত সমাজ সৃষ্টি করতে গিয়েই হুমায়ুন আজাদ-অভিজিৎ-অনন্তের মতো মানুষ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জঙ্গীবাদী শক্তির হাতে প্রাণ দিয়েছেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নিয়ে আমরাও নিঃশঙ্ক চিত্ত অর্জন করতে পারব, গড়ে তুলতে সক্ষম হবো একটি ন্যায় ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের, যে সমাজ দুর্বলের ওপর চড়াও হয় না, সংখ্যালঘুরা নিজেদের শক্তিহীন মনে করে না। একজন রাজনীতি সচেতন শিক্ষক হিসেবে জীবনে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বার্থ এবং মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির বিপরীতে কিছু করিনি। সামনের দিনগুলোতে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও সে পথ থেকে বিচ্যুত হবো না এই আশ্বাস দিচ্ছি। জয় বাংলা। পুনশ্চঃ আমার এই কৈফিয়ত লেখার পর জাসদের দু’দিনব্যাপী জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর আগে জাসদের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়, জাতীয় কাউন্সিলে আমাকে একজন কাউন্সিলর মনোনীত করা হয়েছে। ১১ মার্চ, ২০১৬ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং তার পরদিন মহানগর নাট্যমঞ্চে কাউন্সিল অধিবেশনে আমি উপস্থিত ছিলাম অতিথি হিসেবে নয়, একজন কাউন্সিলর হিসেবেই। অনেক বছর পর সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। অন্যরকম অনুভূতি। কত পুরনো মুখ। বয়সের ছাপ ও ক্লান্তি অনেকের অবয়বে। নবীনেরাও আছেন। কিন্তু তারাও যেন কত পরিচিত। মনের পর্দায় পরপর ছবিগুলো ভেসে উঠল। লক্ষ্যে অবিচল, জীবনদানে নিঃশঙ্কচিত্ত অসংখ্য শহীদ সাথীদের মুখ। সাহস ও আত্মদানের বীরত্বগাঁথা। অন্যদিকে শীর্ষ নেতাদের নীতিভ্রষ্টতা-আত্মহনন। দলের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। এক গভীর বেদনা ও আশাভঙ্গের ছবি। তারপরও জাসদ বিলীন হয়নি। তৃণমূল নেতা কর্মীরা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এক অন্য আলো দেখলাম সবার চেহারায়। অজান্তেই মনে পড়লো কবিগুরুর অমরবাণী : “বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা। স্বর্গ কি হবে না কেনা। বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ?’ পরদিন সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে সারাদিন চললো কাউন্সিল। দলে যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আছে তা প্রত্যক্ষ করলাম। ভিন্নমত-যার প্রতি জাতীয় কমিটির অধিকাংশের সায় নেই- তাও কাউন্সিলরদের মধ্যে বিতরণের সুযোগ দেয়া হলো। প্রাণবন্ত খোলামেলা যুক্তিতর্ক উপস্থাপিত হলো সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টের ওপর। কঠিন সমালোচনাও হলো কোন কোন প্রশ্নে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিবিষ্ট চিত্তে বাকিরা শুনলেন সেসব আলোচনা। স্থির ধৈর্যে সাধারণ সম্পাদক তার জবাব দিলেন। সমালোচনা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি সম্মান জানালেন। দলের ঘোষণা ও গঠনতন্ত্রে সংশোধনী বিষয়েও বিষদে আলোচনা হলো। বহুদিন পর একটি রাজনৈতিক দলের সভায় যোগ দিয়ে বড় স্বস্তি পেলাম। রাত হয়ে গেছে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য কাউন্সিল সভার শেষ অধিবেশন। সারাদিনের ক্লান্তির পরও গভীর প্রত্যাশা ও ধৈর্য নিয়ে সবার অপেক্ষা চলছে। তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন মঞ্চে আসন নিয়েছেন। সভাপতি পদে একটি নাম এলো। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচন সম্পন্ন হলো। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রথমে একটি নাম প্রস্তাব হলো। তাতেও হর্ষধ্বনি। কিছু কাউন্সিলর মাইকে এই প্রার্থী কণ্ঠভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন বলে সেøাগান দিলেন ভিন্ন আর কোন প্রার্থী আছেন কিনা তা না জেনেই। অল্পক্ষণ পরেই আরেকজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব হলো। সেই প্রার্থী মাইক নিলেন এবং পক্ষে-বিপক্ষের সমর্থকদের শান্ত হতে আহ্বান জানাতে থাকলেন। গোল বাধল যখন তিনি বক্তব্য রাখতে চাইলেন। নির্বাচন কমিশনার জানালেন, যেহেতু তিনি প্রার্থী তাই বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই। তার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি কাউন্সিল সভা ত্যাগ করলেন। তাকে অনুসরণ করলেন কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সাথী। মুহূর্তের মধ্যে ভোজভাজির মতো সব ঘটনা ঘটে গেল। বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। এরপরের বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। তা সবার জানা। বাংলাদেশে বাম রাজনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আবারও নগ্নভাবে প্রকাশিত হলো জাসদের ক্ষেত্রে। বহু আশা-স্বপ্ন নিয়ে সারাদেশ থেকে আগত জাসদ নেতাকর্মীরা যেন কিছু নয়, দেশের মানুষের গভীর প্রত্যাশার যেন কোন মূল্য নেই। একটি পদের জন্য দলের বিভক্তি। একটু বিবেচনা, একটু ছাড় যেন এতই মহার্ঘ। জাসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে আমার কৈফিয়ত এবং তারপর জাসদে ভাঙ্গনÑ কি করবো আমি এখন? গতকালের কিস্তিতে আমার বক্তব্য, “সক্রিয় রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে জাসদকে বেছে নিতে আমাকে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়নি”Ñ তাতে আমি স্থির এবং অটল থাকব। যারা চলে গেছেন, তাদের আন্তরিক আহ্বান জানাব জানাব, ফিরে আসুন। সুখে-দুঃখে বহুকাল চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজ আমরা মিলিত হয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে। ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুতই তা অর্জিত হবে। আপনারা ফিরে না এলে তা তা অর্জন কঠিন হবে কিন্তু তা অনার্জিত থাকবে না। কারণ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আমরা এগিয়ে যাবই। আবারও জয় বাংলা। লেখক : অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×