ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

অর্থ হ্যাকিং এবং প্রশ্নবিদ্ধ ডিজিটাল সুবিধা

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৮ মার্চ ২০১৬

অর্থ হ্যাকিং এবং প্রশ্নবিদ্ধ ডিজিটাল সুবিধা

‘উইকিলিক্স’ যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় গোপন নথিগুলো প্রকাশ করা শুরু করেছিল, তারপর যখন দেখা গেল তারা গোপনীয় হাজার হাজার রাষ্ট্রীয় তথ্য, নোট প্রকাশ করে ফেলেছে, তখনি আইটিতে অজ্ঞ আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, রাষ্ট্রের প্রশাসন, কূটনীতি, সমরনীতি, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে যেসব গোপন তথ্য আদান-প্রদান করা হয় সেসব যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলে এর ফল কোন রাষ্ট্রের জন্য, এমনকি ব্যক্তির জন্যও সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি বয়ে আনতে পারে। এরপর বাংলাদেশ। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সেøাগান- ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার শুনলাম। সারাদেশে দ্রুত ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের সেবা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে দেখলাম। এরপর মোবাইলে যখন সারাদেশে, গ্রামেও অর্থ পাঠানো সম্ভব হলো, তখন ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেল বলে মনে করলাম। যারা কেনাকাটায় এটিএম কার্ড ব্যবহার করা শুরু করলেন, তখন কেন জানি না মনে হলো এ কার্ডটি কি আমাদের ব্যাংকে রাখা অর্থকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে? যদিও আমরা মাঝে মাঝে ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে অর্থ চুরির ঘটনা দেখেছি, দেখেছি অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি, তারপরও ব্যাংকে টাকা রাখা, চেক দিয়ে টাকা উঠানো, নগদ টাকা দিয়ে কেনাকাটা করায় অভ্যস্ত আমরা এটিএম কার্ডকে এখনও আস্থায় নিতে পারিনি। এই সেদিন এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে বিদেশীসহ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তা ধরা পড়েছে। টাকা উত্তোলনের ঘটনা এসএমএস আসাতে ক্লায়েন্ট জানতে পারেন এবং ব্যাংকে জানান যে, তিনি কোন টাকা ওঠাননি। কেন ব্যাংক এটি জানতে পারেনি? এভাবে ওই চুরিতে খুব বেশি অর্থ যায়নি। কিন্তু এর কদিনের মধ্যেই মধ্যরাতে একটি ব্যাংকের শাখার ভল্ট ভেঙ্গে প্রায় দু’কোটি টাকা চোরেরা নিয়ে যেতে সক্ষম হয়; চোর ধরা পড়লেও এখনও উদ্ধার হয়নি। এবার আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রে রাখা গচ্ছিত অর্থের একটি বড় অঙ্ক হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কায় তুলে নিয়ে যাবার বিপজ্জনক ঘটনার তথ্য এক মাস পর ফিলিপাইনের এক পত্রিকা সূত্রে প্রকাশিত দেশী সংবাদপত্র থেকে জানা গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো এ ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং এর লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ ও এর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিতকে ধ্বংস করা। প্রশ্ন জাগল মনেÑ ১. প্রধানমন্ত্রী ও তার পুত্র আইটি উপদেষ্টা জয়ের সফলতার ক্ষেত্র ডিজিটাল বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করতে; সফল, দক্ষ, পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এ ঘটনার প্রধান লক্ষ্য নয় তো? ২. বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির কয়েকটি শর্ত পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস, গার্মেন্ট রফতানি, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধি, ডলার টাকার মানের স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করার একটি দেশী-বিদেশী চক্রের প্রচেষ্টা নয়তো? ৩. সবকিছুর ওপরে অবশ্যই একটি প্রশ্ন বারবার মনকে বিষাদে আক্রান্ত করছে যে, শুক্র, শনি ছুটি থাকলে ছুটির দিনগুলোতে যদি ব্যাংকে হ্যাকিং বা অনেক টাকা স্থানান্তর হয়, যা হতেই পারে, সেটি কি কমপক্ষে গবর্নরসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কোন মাধ্যমে কোনই সিগন্যাল পাঠাবে না? এটি হতে পারে? যদি না পাঠায় তাহলে এই ইলেক্ট্রনিক অর্থ ট্রান্সফারকে আর যাই হোক ডিজিটাল বলা যাবে না। দেশের শত্রু, যুদ্ধাপরাধী বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রতি শুক্র, শনিবার বিপুল অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ যে কোন ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তাহলে কি আমরা আন্তর্জাতিক হ্যাকার ও দেশী শত্রুদের দয়ার ওপর নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, অন্য ব্যাংকে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ রাখছি? তাহলে ঈদের লম্বা ছুটিগুলোতে তো হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ খালি করে ফেলবে! এখন জানতে পারলাম, আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংক থেকে মেসেজ এসেছিল, যার কোন উত্তর কোন কর্মকর্তা দেয়নি। শুক্রবার যে কর্মকর্তার ডিউটি ছিল তিনি কম্পিউটার নিষ্ক্রিয় দেখেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চলে গেছেন। এর চাইতে আশ্চর্যজনক ঘটনা আর কি হতে পারে? তাহলে হ্যাকারদের এখান থেকে সহায়তা করেছে বলে মনে হয় না কি? ৪. দেখা যাচ্ছে এই অর্থ হ্যাকিং একবছর আগে থেকে পরিকল্পিত হয়েছে এবং ফিলিপাইনের যে ব্যাংকটিতে টাকাগুলো (৮১ মিলিয়ন ডলার) যে ৫টি এ্যাকাউন্টে এসেছিল সেগুলো প্রতিটি ৫০০ ডলার দিয়ে খোলা হয়েছিল ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই তথ্যটিই প্রমাণ করে এ বিপুল অর্থ ডাকাতি শুধুমাত্র ডাকাত বা হ্যাকাররা করেনি, এদের নিয়োগ করেছে এমন কতিপয় রাষ্ট্রদ্রোহী দেশী-বিদেশী ব্যক্তি, গোষ্ঠী যারা ২০০৬-এর নির্বাচনকে ২০০১-এর নির্বাচনের মতোই দলীয় নেতৃত্বে পরিচালনা করতে অন্যায় চেষ্টায় রত ছিল। এদের কারণেই ২০০৭-এ সেনাপ্রধান এম. ইউ আহমেদ হস্তক্ষেপ করে খালেদা-তারেক-নিজামীদের ওই দেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে ড. ফখরুদ্দীনের অধীনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ড. শামসুল হকের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ২০০৮ সালে। সেনাপ্রধান নেতৃত্ব না নিলে নেতৃত্ব নিয়ে নিত ডিজিএফআই; যারা আদৌ নির্বাচন দিত কিনা সন্দেহ, দিলেও সেটি কোন্্ নেত্রীর পক্ষে দলীয় নির্বাচন হতো, সে আশঙ্কা জনগণকে শঙ্কিত না করে পারে না। কেননা, ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ তো সদ্য বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধপন্থী চৌদ্দদলীয় জোটকে পদচ্যুত করতেই সংঘটিত করা হয়েছিল; যার নেপথ্যের পরিকল্পকদের ভূমিকা ও পরিচয় এখনও উদ্ঘাটন করা হয়নি। যাই হোক, আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধপন্থী জোটের সরকারের সফলতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় অঙ্কের অর্থ লুট অবশ্যই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল এবং এতে দেশী-বিদেশী চক্র জড়িত, তাতে সন্দেহ নেই। ৫. প্রশ্ন উঠেছে, যদি এরা শুধু অর্থ লুটেরা হ্যাকার হতো তাহলে ওদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য সঠিক, শুদ্ধ বিদেশী সহায়তার প্রকল্পের নাম, খুঁটিনাটি তথ্য ব্যবহার করার দরকার হতো না। এটিই প্রমাণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ তথ্যগুলো হ্যাকারদের পাচার করেছে। শোনা যাচ্ছে ওরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য মুছে দিয়েছে, যে কাজটি সন্দেহের সূত্রপাত করে। যা ঘটেছে ব্যাংকের অভ্যন্তর থেকেই সম্ভবত। এ হ্যাকিং সংঘটিত হয়েছে কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, মুছে ফেললে অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের পরিচয়, ভূমিকার তথ্যও মুছে যাবে তা কেবল ওই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই জানার কথা। তাদের নিরাপত্তার জন্য ওইসব তথ্য মুছে ফেলা দরকার। ৬. এর পাশাপাশি মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাওয়া বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে অবশ্যই মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর এমওইউ স্বাক্ষর করার পরও পনেরো লাখ শ্রমিক নেয়ার চুক্তিটি আকস্মিকভাবে অকার্যকর ঘোষণা করা। উল্লেখ্য, শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের বিদেশী অর্থ উপার্জনের একটি বড় উৎস। এর আগে মালয়েশিয়া ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার কয়েক বাঙালীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে নিয়েছে। এই ঘোষণাটিইবা এখন হলো কেন? বিশেষ করে এমওইউ স্বাক্ষরের পর কোন মন্ত্রী এটি হয়ত স্থগিত করতে পারতেন; কিন্তু চুক্তি ক্যানসেল করা কি একেবারেই কাকতালীয়? ৭. একই সঙ্গে প্রায় বিমানে ইংল্যান্ডে কার্গো প্রেরণের ওপর যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা, এমনকি বিমানে যাত্রীবহন নিষিদ্ধ করার হুমকিও এলো। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা আর আসবে না এটাই এখন বাস্তবতা। এ সঙ্গে দেশের সিভিল এভিয়েশন নামক একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা, যারা কাজ না করে মিথ্যাচার করে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে, সেখানে কত সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রয়েছে, তা সরকার ও জনগণের জানা দরকার। সন্দেহ হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী অর্থ স্থানান্তর শাখায় এবং সিভিল এভিয়েশনে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর সুদৃঢ় অবস্থান রয়েছে। নতুবা হ্যাকারদের এক বছর আগে থেকে পরিকল্পনা করে ফিলিপাইনে এ্যাকাউন্ট খোলা, ছুটির দিনে (যদিও মানতে পারি না যে, ছুটি মানেই ডিজিটাল যন্ত্রগুলোও নিষ্ক্রিয়, নীরব থাকবে!) যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন হ্যাঁ, না উত্তর না পেয়েও পাঁচটি অর্ডার মুক্ত করা, ধীরে-সুস্থে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের নদীর ব্রিজ তৈরির প্রকল্পের সঠিক নাম-ধাম দিয়ে অর্থ স্থানান্তর করে সে অর্থ ক্যাসিনো পর্যন্ত ব্যবহার হওয়া, যাতে ওই অর্থ আর সহজে ফিরিয়ে আনা না যায়Ñ এই প্রক্রিয়াটি বড় বেশি পরিকল্পিত মনে হয় না কি? উল্লেখ্য, আমাদের ব্যাংকে ভল্ট থাকে, প্রহরী থাকে, তারপরও ব্যাংকের অর্থ লুটের ৬৭% ঘটনা সংঘটিত হয় ব্যাংকের উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়। সুতরাং এ উপাত্ত ও নির্দেশ করছেÑ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনা জোরালো। এ কথা বলা যায় যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি সুরক্ষা যতটাই থাকুক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরের কোন ব্যক্তি যদি এই হ্যাকিংয়ে যুক্ত থাকে তাহলে কোন সুরক্ষা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিতে পারবে না। পারবে না দিতে অন্য ব্যাংকের অর্থের সুরক্ষা। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যত কষ্টই হোক সে ভূতকে তাড়াতেই হবে। জনগণ এ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে জানতে চায়Ñ কি ঘটেছে, কিভাবে, কারা ঘটিয়েছে এবং দাবি দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি এবং ওই চুরি হওয়া জনগণের অর্থ ফেরত আনা, যত দ্রুত সম্ভব।
×