ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাথর নিয়ে জটিলতা কাটলেও মাসাধিককাল ফল আমদানি বন্ধ

সোনামসজিদ বন্দরে ফল আমদানিতে জটিলতা

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৮ মার্চ ২০১৬

সোনামসজিদ বন্দরে ফল আমদানিতে জটিলতা

ডি. এম. তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ প্রায় সপ্তাহ ধরে সব ধরনের আমদানি রফতানি বন্ধ থাকার পর সোনামসজিদ স্থলবন্দর আবার সচল হলেও বড় ধরনের রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়ল। যার পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বন্দরের এই অস্থিরতা ও স্থবিরতার সৃষ্টি করেছে ভারতীয় রফতানিকারকরা। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের জটিল সমস্যার অন্যতম কারণ বার বার কোন কারণ ছাড়াই বোল্ডার পাথরের মূল্যবৃদ্ধি। পাশাপাশি রফতানি হয়ে আসা প্রতি ট্রাকে দুই থেকে তিন টনের অধিক মাটি মেশানো নিম্নমানের পাথর পাঠানো। এখানে উল্লেখ্য, বন্দরটিতে বর্তমানে প্রধান রাজস্ব আদায়ের সোর্স হচ্ছে বিহারের পাকুড় থেকে আসা পাথর। কিন্তু এই পাথর নিয়ে ভারতীয় রফতানিকারকদের ছলচাতুরী, শর্ত ভঙ্গ করে নিম্নমানের পাথর ঠেলে দেয়া, বার বার কোন কারণ ছাড়াই পাথরের মূল্যবৃদ্ধি ও রফতানিকৃত পাথর সরাসরি সোনামসজিদে না এনে তা পাকুড় থেকে ভারতের মোহদিপুর বন্দরে আনলোড করে পুনরায় লোড করার সময় তাতে কয়েক টন মাটি ভরে দেয়া নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের পাথর আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা এই নিয়ে ফুঁসে উঠে বার বার প্রতিবাদ ও যৌথ বৈঠকে বসার পরেও শর্ত ও চুক্তি ভঙ্গ করা ভারতীয় রফতানিকারকদের সাধারণ আচারণে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশী পাথর আমদানিকারকরা এসব কারণে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলে চলতি মাসের (মার্চ) ৬ তারিখ থেকে পাথর আমদানি বন্ধ করে দেয়। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ’ ট্রাক থেকে (পাথরের) রাজস্ব বন্ধ হবার ফলে সরকার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়ে বন্দরে কাজ করা একাধিক সংগঠনের প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশী আমদানিকারকরা পাথর আমদানি বন্ধ করলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় সকল শ্রেণীর পণ্যের রফতানিকারকরা জোট বেঁধে সোনামসজিদ বন্দরে সব ধরনের পণ্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। বন্দরজুড়ে পড়ে যায় হাহাকার। সরকারী রাজস্ব হারানোর বিষয়টি দৃশ্যমান না হলেও বন্দরের সব ধরনের পণ্য আসা বন্ধ হয়ে পড়াতে শ্রমিকদের শুরু হয় মানবেতর জীবনযাপন। তাদের পুরো পরিবার পড়ে যায় অনাহারের মুখে। বাধ্য হয়ে সোনামসজিদ বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সব শ্রেণীর সংগঠন। বিশেষ করে সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট ও রফতানিকারকরা ভারতীয় মহদীপুর বন্দরের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে প্রতিদিন সোনামসজিদ স্থল বন্দর হয়ে আমদানিকারকরা গড়ে চার শ’র বেশি ট্রাকে বোল্ডার ও ছোট পাথর আমদানি করে থাকে। কিন্তু ভারতীয় রফতানিকারকরা নিম্নমানের পাথর সরবরাহ ও দফায় দফায় পাথরের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জটিলতায় গত মাসের দুই দিন মহদিপুর এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করে সোনামসজিদ বন্দর আমদানিকারকরা। বৈঠকে পরিষ্কার মানস্পন্ন পাথর সরবরাহ, টনের পরিবর্তে সেফটিতে ওজন এবং প্রতি টন ১৮.৫ ডলারের স্থলে ১৪ ডলারে পাথর সরবরাহের পাক্কা লিখিত ডিল তৈরি হয়। কিন্তু ডিল হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মহদিপুর এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন তা ভঙ্গ করে সোনামসজিদ আমদানিকারকদের জানিয়ে দেয় তারা চুক্তি শর্তে পাথর দিতে পারবে না। ফলে সোনামসজিদ বন্দরে পাথর আমদানি স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই অচলাবস্থা কাটাতে আবারও সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পর তাদের বেঁধে দেয়া দরেই পাথর আনা শুরু হলেও ভারতীয় রফতানিকারকদের ভেজাল পাথর দেয়ার প্রবণতা একটুও কমেনি। ফলে আবারও যে কোন সময় পাথর আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রচ- চাহিদার মুখে পদ্মা সেতু প্রকল্প ও রূপপূর আণবিক কেন্দ্রের জন্য পাকুড়ের পাথর আমদানি করা হচ্ছে। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে দাম বৃদ্ধি করে চলেছে ভারতীয় রফতানিকারকরা। বার বার অনুরোধ উপরোধের পরেও নিম্ন মানের মাটি মেশানো পাথর ঠেলে দেয়া বন্ধ করেনি ভারতীয় রফতানিকারকরা। সোনামসজিদ বন্দরে বিশাল আকারের বড় ধরনের দ্বিতীয় সমস্যার জট অর্থাৎ ফল আমদানি নিয়েও জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কোন ভারতীয় ফলের ট্রাক সোনামসজিদ বন্দরে ঢুকছে না অথচও ভৌগোলিকভাবে সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে ভারতের বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদনকারী এলাকা খুবই কাছাকাছি। আমদানিকারকরা তাই সোনামসজিদ দিয়ে ফল আমদানী করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমনকি সময় কমের পাশাপাশি খরচও কম হয়। তার পরেও গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে ফল আনা বন্ধ করে দিয়েছে আমদানিকারকরা। প্রতিদিন বেদানা, আঙ্গুর, কমলা, মালটা, আপেল ও লেবু জাতীয় ফল নিয়ে শতাধিক ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করতো। সেসব ফল আমদানিকারক তাদের ব্যবসা বন্ধ না করে সোনামসজিদ বন্দর ছেড়ে অন্যান্য বন্দর ব্যবহার করছে। তাদের অভিযোগ একই দেশের মধ্যে দ্বিমুখী খামখেয়ালীপনা নীতির কারনে তারা সোনামসজিদ বন্দর ছেড়েছে। তাছাড়া সোনামসজিদ রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতির খায়েশ ও প্রবণতা খুবই বেশি। ফল পণ্য পচনশীল হওয়ার কারণে রাজস্ব আদায়ে ১০% ভাগ ছাড় দেয়ার কথা থাকলেও বন্দর কাস্টমস তা মেনে কাগজে কলমে তা ছাড় রেখে শতভাগ আদায় করছে। বাকিটা অর্থাৎ ছাড় দেয়া ১০% ভাগ নিজেদের পকেটে পুরছে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে সোনামসজিদ কাস্টমস। ফলে ফল আমদানিকারকরা সোনামসজিদ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে পাশাপাশি অন্যান্য বন্দরে। ভোমরা ও হিলি স্থলবন্দরে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকার কারণে আমদানিকারকদের এই বন্দর ছাড়ার অন্যতম কারণ। সোনামসজিদে শুধু ফল থেকেই প্রতিদিন লাখ টাকার রাজস্ব আসত প্রতি ট্রাকে। ফল আমদানি না থাকায় মাসখানেক থেকে তা বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রতিদিন হারাচ্ছে প্রায় দুই কোটি টাকার রাজস্ব। একটি সূত্র জানিয়েছে ২১ দিনে কাস্টমস রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বন্দর সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট সভাপতি হারুনর রশীদ জনকণ্ঠকে জানান, দেশের সব বন্দর দিয়ে মিক্সড ফল আমদানি হলেও সোনামসজিদ দিয়ে তা আনতে দিচ্ছে না। তিনি একই নিয়মে সব বন্দরে পরিচালনার দাবি জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ফল আমদানি জটিলতা ও রাজস্ব ছাড় দেয়ার (সংরক্ষিত মালামালে) বিষয়টি তারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের গোচরে ইতোমধ্যেই এনেছে। কারণ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক তারা পরিচালিত। এদিকে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পাথর আমদানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গত শনিবার (১২ মার্চ) জিরো পয়েন্টে উভয় দেশের আমদানি রফতানিকারক ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট নেতৃবৃন্দের দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের পুরো বিষয় সম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও আবার পাথর আসছে। তবে এই পাথর আসা কতদিন স্থায়ী হবে তা নিশ্চিত করে কোন পক্ষই বলছে না। পাশাপাশি ফল আমদানি নিয়ে জটিলতা না কাটায় সোনামসজিদ আমদানিকারকরা বন্দর ছেড়ে গেছে। তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ও অন্যান্য বন্দরের মতো সুযোগ সুবিধা দিতে সোনামজিদ কাস্টমস কোন পদক্ষেপ না নিয়ে অনড় থাকায় আপাতত এই বন্দর দিয়ে ফল আমদানির কোন সম্ভাবনা নেই। বিধায় সোনামসজিদ স্থলবন্দরটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর হওয়ার পরেও এখানকার রাজস্ব বিভাগ তাদের মতো করে পরিচালনা করায় বন্দরের জট কাটছে না। এ ব্যাপারে সবার অনুরোধ রাজস্ব বিভাগের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
×