ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঐক্যের জন্য জাসদের বিকল্প কমিটি পুনঃ অধিবেশন চায়

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১৭ মার্চ ২০১৬

ঐক্যের জন্য জাসদের বিকল্প কমিটি পুনঃ অধিবেশন চায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শর্তের বেড়াজালে বন্দী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ঐক্য। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দলে এতবড় ভাঙ্গন দেখা দেবে, তা কেউ ভাবেননি। জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। ঘোষণা হয় পাল্টা জাসদ। এ ঘটনায় তৃণমূলের নেতারাও আছেন বিভ্রান্তির মধ্যে। তবে ভেতরে ভেতরে চলছে ঐক্য প্রক্রিয়া। নিরপেক্ষ অবস্থানে গিয়ে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উভয় পক্ষের প্রতি ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। এজন্য পাল্টাপাল্টি শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন দু’পক্ষই। তবুও শেষ পর্যন্ত ঐক্যের ব্যাপারে আশাবাদী সবাই। এদিকে ১৯৭২ সালে জাসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর অন্তত পাঁচবার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে দলটি। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বেই এ ভাঙ্গন বলে দাবি করছেন নেতাকর্মীরা। গত ১২ মার্চ দলীয় কাউন্সিলে শিরিন আখতারকে সাধারণ সম্পাদক করাকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে এসে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন জাসদের একাংশ। সেখানে বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি এবং নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিতে বিদায়ী কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদলও রয়েছেন। এই পক্ষের দাবি দলের ১৪ জন স্থায়ী কমিটির সদস্যের মধ্যে ১০ জনই আছেন তাদের সঙ্গে। তাদের দিকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের পাল্লা ভারি বলে দাবি করা হচ্ছে। বিভক্তির পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্রোহীদের দলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, কাউন্সিলে ভোটে জিতে শিরিন আখতার সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তবে ফিরে আসার জন্য ওই ভোট বাতিল করে নতুন করে কাউন্সিল অধিবেশন চেয়েছেন নুরুল আম্বিয়া। কাউন্সিল ছেড়ে আলাদা জাসদের ঘোষণা দেয়া শরীফ নুরুল আম্বিয়া দলে ফিরতে পুনরায় নেতৃত্ব নির্বাচনের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের শর্ত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের আহ্বান করল আর আমরা চলে গেলামÑ এমন তো নয়। তারা আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা তা রাখতে পারিনি। তবে শর্ত মানলে ঐক্য হতে পারে। বুধবার তিনি বলেন, দলের অনেক সিনিয়র নেতা আমাদের ঐক্যের কথা বলেছেন। হ্যাঁ, আমরাও ঐক্য চাই তবে ঐক্য করতে হলে পূর্বের অধিবেশন বাতিল করে নতুন অধিবেশন ডাকতে হবে। নতুন করে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা দলের সঙ্গে ঐক্য করতে পারি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেছেন, সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি নেতাদের মাধ্যমে তাদের দলে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা দলে না এলে তো আর আমাদের কিছু করার নেই। সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় ভোটের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন করে অধিবেশন করতে হলে তো আলোচনা করতে হবে। আর এ আলোচনা আমরা কাদের সঙ্গে করব? তারা যে কমিটি দিয়েছে সেটা বাতিল করে আমাদের সঙ্গে এসে বসুক। তখন আলোচনার মাধ্যমে নতুন অধিবেশন দরকার হলে অধিবেশন হবে, আবার ভোট হবে। এদিকে জাসদ নেতা লুৎফা তাহেরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উভয় পক্ষের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সমাজতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। আপনারা ইচ্ছে করলে আমার বাসায় ঐক্যের আলোচনা নিয়ে বসতে পারেন। আমি রাজি। আমার প্রত্যাশা জাসদ আবারও একসঙ্গে চলবে। তবে দলের ভাঙ্গন নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন জাসদ নেতারা। ভাঙ্গনের জন্য দুষছেন একে অপরকে। নানা বিশেষণে অভিহিত করছেন পরস্পরকে। তাদের এ বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসছে দল ভাঙ্গার নেপথ্যের নানা কারণ। শনিবার দলের কাউন্সিলে হাসানুল হক ইনুকে সভাপতি এবং শিরিন আখতারকে সাধারণ সম্পাদক করার পরই মূলত এই ভাঙ্গনের সৃষ্টি। এ নিয়ে পরদিন দলীয় নেতাদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কুৎসা রটনা চলতে থাকে। সংসদ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন গ্রুপের কার্যকরি সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল দলের ভাঙ্গনের জন্য শিরিন আখতারকে দায়ী করে বলেন, হেলেনের জন্য যেমন ট্রয়নগরী ধ্বংস হয়েছে, ঠিক সেভাবেই শিরিনের জন্য জাসদ ভেঙ্গেছে। তিনি আরও বলেন, জাসদকে বাঁচাতে হলে হাসানুল হক ইনুকে শিরিনের মায়া ত্যাগ করতে হবে। অনুরূপভাবে জাসদের ভাঙ্গনের জন্য শিরিন আখতারের সাধারণ সম্পাদক হওয়াকেই দায়ী করলেন একাংশের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান। তিনি বলেন, নামমাত্র কণ্ঠভোটে শিরিন আখতার সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। অথচ স্বচ্ছভাবে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাভুটি হলে আমিই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতাম। হাসানুল হক ইনু শিরিনের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তার কারণেই দলের এ অবস্থা। একই অভিযোগ করেন দলের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়াও। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। এ প্রতিবাদেই আমরা কাউন্সিল সদস্যদের চাপে বাধ্য হয়ে কমিটি ঘোষণা করেছি। অন্যদিকে, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক দল ভেঙ্গে যাওয়া নেতাদের বিভ্রান্ত ও জঙ্গীদের সহযোগিতার ষড়যন্ত্র করেছেন বলে অভিযোগ করেন। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ দলীয় কার্যালয়ে তিনি বলেন, এরা (আম্বিয়া-প্রধান) জঙ্গীবাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। তিনি বলেন, এসব জ্যেষ্ঠ নেতারা যদি সত্যিকার অর্থেই জাসদের প্রতি অনুরাগী হয়ে থাকেন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন তাদের স্বপ্ন হয়ে থাকে, তাহলে তারা অবশ্যই ফিরে আসবে। দলের গঠনতন্ত্র ও নীতি আদর্শের প্রতি সমর্থন রেখে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে ফিরে আসার আহ্বান জানান ইনু। ভাঙ্গাগড়ার জাসদ ॥ ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর দলটির সাত সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা হয়। তখন আবদুল জলিল হন সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রব হন যুগ্মআহ্বায়ক। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অতিরিক্ত কাউন্সিলে ১০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ সম্মেলনে জাসদ তার ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করে। ১৯৮০ সালে বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে প্রথম জাসদ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। তখন জাসদ থেকে রেবিয়ে একদল নেতা বাংলাদেশের সমাজতান্দ্রিক দল (বাসদ) গড়ে তোলেন। ১৯৮৬ সালে কাজী আরেফ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ পুনর্গঠন করা হয়, যা পরে জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে জাসদ আবার ভেঙ্গে সাত ভাগে বিভক্ত হয়। মীর্জা সুলতান রাজা ও শাহজাহান সিরাজ ঐক্য জাসদ গড়ে তোলেন। ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু) এবং বাসদের (মাহাবুব) একাংশ মাঈনুদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। তখন আ স ম রবকে সভাপতি এবং হাসানুল হক ইনুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ২০০২ সালে আ স ম রবের নেতৃত্বে কতিপয় নেতা জেএসডি নামে জাসদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০০৪ সাল থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ ১৪ দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে মহাজোট গঠিত হলে জাসদ মহাজোটের শরিক হয়। বর্তমানে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু মহাজোট সরকারে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন। সর্বশেষ দলের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে আবারও ভাঙ্গন দেখা দেয়। উভয়পক্ষের মধ্যে কার্যালয় দখল ও প্রতীক নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে। ১০ম জাতীয় সংসদে জাসদের মোট ৬ সংসদ সদস্য রয়েছেন।
×