ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাউন্সিল করে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল বিএনপির

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৭ মার্চ ২০১৬

কাউন্সিল করে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল বিএনপির

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। ঝিমিয়ে পড়া এ দলটি জাঁকজমকভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করে রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল নিয়েছে। ইতোমধ্যেই সারাদেশের সকল কাউন্সিলর ও দেশী-বিদেশী অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শেষ করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন নতুন পদ সৃষ্টিসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়ানো ও বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য জমা হওয়া ৫৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ২৫টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার রাতে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় জাতীয় কাউন্সিলের জন্য যাবতীয় কর্মকৌশল অনুমোদন করা হবে। জানা যায়, জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে গঠিত ১৭টি উপকমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে যাবতীয় কর্মকৌশল সম্পন্ন করে তা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অবহিত করেছেন। ১৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলের দিনে উদ্বোধনী অধিবেশনে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ভেতরে প্রায় ৩ হাজার কাউন্সিলরসহ দশ হাজার লোকের বসার ব্যবস্থা করা হবে। মঞ্চ করা হচ্ছে খোলা চত্বরে। এ ছাড়া জাতীয় কাউন্সিল দেখতে আসা আরও অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর অবস্থানের জন্য পাশের সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে জাতীয় কাউন্সিলের কর্ম অধিবেশনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সম্মেলন কক্ষ প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি মহানগর নাট্যমঞ্চও বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বিএনপিকে কাউন্সিলের জন্য মহানগর নাট্যমঞ্চ বরাদ্দ দেয়ার কথা জানিয়েছেন। এদিকে জাতীয় কাউন্সিল চলাকালে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে নিরাপত্তা বলয়ের জন্য ১০০ ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা), ডজন তিনেক আর্চওয়ে ও প্রায় ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হচ্ছে। এর বাইরে থাকবে বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা (সিএসএফ)। আর কাউন্সিলের জন্য নির্ধারিত এলাকাটিতে যাতে দলীয় নেতাকর্মীরা কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখবে তারা। এসব কাজ যাতে সঠিকভাবে করা যায় এ জন্য দফায় দফায় দলের সিনিয়র নেতারা ভেন্যু পরিদর্শন করছেন। বিশেষ করে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি উপকমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এখন দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন। একের পর এক বৈঠক করে তারা প্রস্তুতি কাজ শেষ করছেন। মঙ্গলবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল সফলের জন্য ৯৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। কাউন্সিল সফলে ১০০ ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি), ডজন তিনেক আর্চওয়ে বসানো হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় এক হাজার শৃঙ্খলাকর্মী সর্বক্ষণিকভাবে পুরো এলাকা মনিটর করবে। আর যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের হলরুম ছোট অর্থাৎ এখানে আসন আছে মাত্র ৮০০। তাই কর্ম অধিবেশেন মহানগর নাট্যমঞ্চে করার চেষ্টা চলছে। এর আগে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি সাময়িক বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। জাতীয় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে পদ-পদবি ও পদোন্নতি প্রত্যাশীদের ভিড় জমছে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের বাসা ও অফিসে। আর কোন কোন নেতা এ জন্য লন্ডনে অবস্থান করা দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন। আর এ সুযোগে তারেক রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিএনপি নেতাদের কাছ থাকে সুবিধা আদায় করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের মধ্যে বিতরণের জন্য বেশ ক’টি বই প্রকাশ করেছে বিএনপি। এসব বইয়ে বিএনপির ইতিহাস এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের নেতাদের কর্মকা- তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি আমলে করা দেশের উন্নয়ন চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের আমলের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও খুনখারাবির ঘটনাও থাকছে এসব পুস্তকে। এ ছাড়া বিএনপি ও ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষে থেকে বিভিন্ন সেøাগান সংবলিত পোস্টার ছাপা হয়েছে ৫ লক্ষাধিক। বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য দলের চেয়ারপার্সনের একটি দীর্ঘ বক্তব্যের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। কাউন্সিলরদের জন্য দুপুর ও রাতের খাবার এবং চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি টিম করা হয়েছে। কাউন্সিল শেষে থাকছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে থাকছে জাসাস নেতারা। বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পোস্টার, দেয়াল লিখন, লাইটিং করা হচ্ছে। আর পোস্টার লাগানো হয়েছে সারাদেশে। দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আজ বুধবার থেকে কাউন্সিলর কার্ড বিতরণ শুরু হচ্ছে। কাউন্সিল উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোলা বিএনপির ফেসবুক পেজটিতে কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রস্তুতির তথ্য দেয়া হয়েছে। দলের নেতাকর্মীরাও ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে এক মাস আগেই সারাদেশের কাউন্সিলদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য প্রস্তাব জমা দিতে। কাউন্সিলরদের কাছ থেকে পাওয়া ৫৫টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটি ২৫টি প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশ দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে জমা দিয়েছে। জানা যায়, গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে চেয়ারপার্সনের পদ শূন্য হলে ওই পদে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া এক নেতার একপদ রাখার বিষয়েও প্রস্তাব রয়েছে। খসড়া প্রস্তাবে আরও রয়েছে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ৩৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৫০১ সদস্যের করার সুপারিশ। স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২১ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদ ১৭ থেকে বাড়িয়ে ২১ জন করার সুপারিশ করা হয়েছে। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদকে রাজনৈতিক ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। যুগ্ম মহাসচিব ৭ থেকে বাড়িয়ে ১০ জন করার সুপারিশ করা হয়েছে, সাংগঠনিক সম্পাদকের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১১ জন এবং সহ-সাংঠনিক সম্পাদক প্রতিটি বিভাগে একজনের পরিবর্তে ২ জন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো বিভিন্ন উপ-কমিটি গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিল করার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। জাতীয় কাউন্সিলকে আকর্ষণীয় করতে যা যা করার তাই করা হচ্ছে। কাউন্সিলর ও দেশী-বিদেশী অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শেষ হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্যও কিছু সুপারিশ সংবলিত খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় কাউন্সিলের সকল প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হবে। বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে গঠিত দফতর ও যোগাযোগ উপকমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। প্রতিটি উপকমিটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সমন্বয়ের কাজ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে উপকমিটিগুলোকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ, যোগাযোগ এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাউন্সিলর, ডেলিগেট ও দেশী-বিদেশী অতিথিদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। বিএনপির অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয় কাউন্সিলের আপ্যায়ন উপকমিটির আহ্বায়ক আবদুস সালাম জানান, এবারের জাতীয় কাউন্সিল হবে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। কাউন্সিলে অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়নের জন্য ১৯টি টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিমের সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ তাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয় করা হচ্ছে।
×