ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৫৫ রানে জিতে পাকিস্তানের শুভ সূচনা

লড়াই করে হারলেন মাশরাফিরা

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৭ মার্চ ২০১৬

লড়াই করে হারলেন মাশরাফিরা

স্পোর্টস রিপোর্টার, কলকাতা থেকে ॥ লাল-সবুজে ছেঁয়ে গেল যেন ইডেন গার্ডেন। বাংলাদেশ জার্সিতে শুধু লালের ছড়াছড়ি। আর পাকিস্তানের জার্সি সবুজে ঘেরা। কিন্তু উল্টো গেল সব ধারণা। বদলে গেল দৃশ্যপটও। যেখানে মনে করা হয়েছিল কলকাতায় বাঙ্গালীদের আস্তানা। এখানে বাংলাদেশের সমর্থনই মিলবে। কিন্তু সেইরকমটি হল না। মনে হলো, পাকিস্তানের সমর্থনই বেশি। একচ্ছত্র সমর্থন বাংলাদেশ পেল না। ৬৬ হাজার ধারণা ক্ষমতার ইডেন গার্ডেন ভরলনা। তবে অর্ধেকের কম যে ভরল, তাতে পাকিস্তানের পক্ষেই শুধু আওয়াজ উঠতে দেখা গেল। সেখানে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গর্জন ঝিমিয়ে পড়ল। ঝিমিয়ে পড়ল যেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও। ‘সুপার টেনে’র প্রথম ম্যাচে জিতে শুভ সূচনা করার স্বপ্ন যে দেখেছিল বাংলাদেশ, সেই স্বপ্ন কেড়ে নিল পাকিস্তান। ৫৫ রানে জিতে গেল। কলকাতায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বর্তমান দলের ক্রিকেটাররা জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। মনে করা হয়েছিল ম্যাচটিতে মুস্তাফিজুর রহমান খেলবেন এবং পাকিস্তান ব্যাটিং লাইন আপকে ধসে দেবেন। আমিরের সঙ্গে তার দ্বৈরথও দেখা যাবে। কিন্তু এ ম্যাচেও খেলতে পারলেন না মুস্তাফিজ। তাতে করে পাকিস্তান ব্যাটিংকে ছন্নছাড়াও করে দেয়া গেল না। উল্টো হাফিজের ৬৪, শেহজাদের ৫২ ও আফ্রিদির ৪৯ রানে পাকিস্তান ৫ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ২০১ রানের বিশাল স্কোর গড়ে ফেলল। যা অতিক্রম করতে পারবে না বাংলাদেশ, তা পাকিস্তান ইনিংস শেষ হতেই বোঝা গেল। শুধু অপেক্ষা ছিল, ব্যবধান কতটা কমাতে পারে বাংলাদেশ, তা দেখার। ২০ ওভারে শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেট হারিয়ে ১৪৬ রান করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে জিততে হলে প্রতি ওভারে ১০ রানের বেশি করে করতে হত। অতি দানবীয় ইনিংস কাউকে না কাউকে খেলতে হত। কিন্তু সেই ইনিংস খেলবেটা কে? সেই প্রশ্নই সামনে আসে। তামিমকে দিয়েই ভরসা থাকে। সঙ্গে সৌম্য যদি কিছু করে দেখাতে পারেন। কিন্তু দলীয় ১ রানেই আমিরের তৃতীয় বলেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোল্ড হয়ে যান সৌম্য। এরপর তামিম-সাব্বিরকে নিয়ে ভরসা করা হয়। সুন্দরভাবে এগিয়েও যেতে থাকেন দুইজনই। কিন্তু ৪৪ রান হতেই সব্বিরকে (২৫) বোল্ড করে দেন আফ্রিদি। ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠার পর বল হাতেও স্পিন দ্যুতি ছড়ানো শুরু করে দেন ‘বুমবুম’ আফ্রিদি। ১৪ রান আরও স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই আগের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করা তামিমকেও (২৪) সাজঘরের পথ ধরান আফ্রিদি। দিনটি যেন তার। তা বোঝাই যাচ্ছিল ব্যাটিংয়ে। বোলিংয়েও একইরকম নৈপুণ্য দেখিয়ে দিলেন। সুযোগ বুঝে দ্রুতই ৪ ওভারও সবার আগে শেষ করে ফেলেন আফ্রিদি। ৬ ওভারে বাংলাদেশও খারাপ করেনি। পাকিস্তান থেকে ১০ রান কম করেছে। ৪৫ রান করেছে। কিন্তু এরপর থেকেই ঝিমিয়ে যেতে থাকেন ব্যাটসম্যানরা। আসলে আমির, ইরফানের পর ওয়াহাব, আফ্রিদি, মালিক ও ইমাদ মিলে এতটাই ভাল বোলিং করেন যে, কোনভাবেই বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা রান তুলতে পারেননি। যেখানে ১০ রানেরও বেশি একেক ওভারে লাগবে, সেখানে ৭ রানের বেশিও রাখা যায়নি। ১০ ওভারে গিয়ে ৬৯ রান যোগ হয় বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে। দ্রুত রান তুলতে হবে। তাই মুশফিককে নয়, নামানো হয় মাহমুদুল্লাহকে। চাপে মাহমুদুল্লাহ (৪) কিছুই করতে পারেননি। ৭১ রানে আউট হয়ে যান। দল হারবে তা পাকিস্তানের ইনিংস শেষ হতেই বোঝা যায়, কিন্তু ৪ উইকেটের পতন ঘটায়, তখন মনে হয় ব্যবধানটা অনেক বড়ই হতে চলেছে। এরমধ্যে একটি প্রাপ্তি অবশ্য মিলে যায়। সাকিব আল হাসান টি২০ ক্যারিয়ারে ১০০০ রান পূর্ণ করেন। কিন্তু ম্যাচ আর জেতাতে পারেননি। ৩৩ রানের সময় ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচেন সাকিব। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন মুশফিককে ঘিরে ধরেছে। ১৮ রানে দলের ১১০ রানের সময় ক্যাচ আউট হন। আবারও ব্যর্থ হন মুশফিক। তখন জিততে ২১ বলে ৯২ রান লাগত। নিশ্চিত হারই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের। একপেশে ম্যাচ হয়ে গেছে। তা বুঝে স্টেডিয়াম থেকে দর্শকরাও বের হয়ে যেতে থাকেন। ১৮ বলে জিততে ৯১ রান লাগে। এমন সময়ে সাকিব দুটি বাউন্ডারি হাঁকান। মিঠুন (২) আউটের পর মাশরাফি ব্যাট হাতে নেমে ছক্কা হাঁকান। একটু অফসাইডে ইয়র্কার দেয়া আমিরের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট ও শর্ট থার্ড ম্যানের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকান মাশরাফি। ৬ বলে জিততে ৬৮ রান লাগে। এমন সময়ে ওয়াহাবের প্রথম বলে আবারও বাউন্ডারি হাঁকান মাশরাফি। তৃতীয় বলে সাকিব হাঁকান ছক্কা। চতুর্থ বলে এক রান নিয়ে অর্ধশতকও করেন আইপিএলে খেলার সুবাদে কলকাতার ঘরের ছেলে হয়ে যাওয়া সাকিব। সেই সঙ্গে অর্ধশতক করে অপরাজিত থাকেন। মাশরাফি ১৫ রানে অপরাজিত থেকে হার নিয়ে মাঠ ছাড়েন। বাংলাদেশ ১৪৬ রানের বেশি করতে পারেনি। সবসময়ই আল আমিন দ্বিতীয় ওভারে উইকেট নেন। কিন্তু এদিন যেন পাকিস্তান ওপেনারদের অন্যরূপেই পাওয়া গেল। শারজিল খানতো আল আমিনের করা প্রথম ওভারেই দুই ছক্কা, এক চার মেরে দিলেন। এক ওভারেই ১৮ রান নিয়ে নিলেন। সেই যে রানের বন্যা শুরু হলো, ইডেন গার্ডেনে ব্যাটিং পিচে তা আর থামলই না। তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বলে শারজিলকে (১৮) বোল্ড করে দিলেন আরাফাত সানি, তাতেও কাজ হলো না। এরপর যে আহমেদ শেহজাদের মারমুখী ব্যাটিংয়ের দেখা মিলে। শেহজাদ ও মোহাম্মদ হাফিজ মিলে যেভাবে খেললেন, তাতে ১০ ওভারেই স্কোরবোর্ডে ৯০ রান যোগ হয়ে গেল। কোনভাবেই আরাফাত, সাকিব, মাশরাফি, সাব্বিরদের সুযোগ দেননি শেহজাদ ও হাফিজ। হুড়হুড় করে স্কোরবোর্ডে শুধু রান যোগ করে গেছেন। পাওয়ার প্লেতেই ৫৫ রান যোগ হয়ে যায়! এশিয়া কাপ টি২০তে শেহজাদকে খেলানোই হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে খেলানো হয়। তাতে যে ১৮ রান করেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে একাদশেও সুযোগ মিলে যায়। সেই সুযোগ কাজেও লাগান শেহজাদ। ৩৫ বলেই অর্ধশতক করে ফেলেন। বিশ্বকাপে যে পাকিস্তানের অন্যরূপ দেখা যাবে, তা পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরামই বলেছিলেন। পাকিস্তান তাই প্রমাণ করল। টস জিতে আগে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে এত বেশি রান যোগ করল যে সেখানেই খেলা শেষ হয়ে গেল! শেহজাদকে (৫২) ১২১ রানের সময় আউট করা গেছে ঠিক, কিন্তু হাফিজকে অর্ধশতক করা থেকে রোখা গেল না। হাফিজের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ৯৫ রানের জুটি গড়ে শেহজাদ আউট হওয়ার পর যে আফ্রিদি ব্যাট হাতে নামলেন, তিনিও হু হু করে রান নিতে থাকলেন। এশিয়া কাপের পুরোটা ব্যর্থ ছিলেন আফ্রিদি। এ নিয়ে কত কথা। নেতৃত্বে চলে যাবে, সেই সমালোচনাও হয়েছে। অথচ তা উল্টে গেল বিশ্বকাপে এসে। আফ্রিদি ব্যাট করতে নেমে নিজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলেই মাশরাফিকে দুটি চার হাঁকালেন। পাকিস্তানের রান দ্রুতই ১৫ ওভারে ১৩৯ রান হয়ে গেল। যেভাবে ব্যাটিং করতে চাইল পাকিস্তান ব্যাটসম্যানরা, সেভাবেই করতে পারল। কোন কিছুই তাদের ব্যাটিংয়ের সামনে বাধা হয়ে ধরা দিতে পারল না। ভাগ্য এতটাই ভাল পাকিস্তান ব্যাটসম্যানদের যে ব্যাটের কানায় লেগেও কয়েকবার বাউন্ডারি হয়ে গেল। ১৬ ওভারে পাকিস্তান ১৫৭ রান করেও ফেলল। ১৬তম ওভারে আল আমিন নিজের তৃতীয় ওভার করতে এসেও ১৮ রান দেন। হাফিজ দুটি বাউন্ডারি হাঁকান ও আফ্রিদি একটি বিশাল ছক্কা হাঁকান। সেই ছক্কার বলটি গ্যালারি গিয়ে পৌঁছে। যখন ১৬৩ রানে পৌঁছে পাকিস্তানের ইনিংস তখন দুর্দান্ত একটি ক্যাচ ধরেন সৌম্য সরকার। আরাফাত সানির বলে ৬৪ রান করা হাফিজের স্কোরবোর্ডে ৬ রান হয়েই যেত। হাফিজ আউটই হয়ে গেলেন। কিভাবে? বাউন্ডারি যে মারলেন হাফিজ, বাউন্ডারির দড়ির একেবারে সামনে থেকে বলটি ধরে আকাশের দিকে উড়িয়ে মেরে আবার নিজের তালুবন্দী করলেন সৌম্য। এরপর উমর আকমল ব্যাট হাতে নামেন। তামিমের সঙ্গে শুধু শুধু তর্ক লেগে গেল। শেষে আম্পায়ারের হস্তক্ষেপে সেই তর্কের অবসান ঘটে। তবে সেই তর্কের ফল পায় বাংলাদেশ। কোন রান না করেই আউট হয়ে যান উমর। সবাই তখন বলাবলি করে, তাসকিন নয়, উইকেটটা নিয়েছেন আসলে তামিম। তার তর্কের ফল যে এটা। পাকিস্তানের একের পর এক উইকেট যেতে থাকে। তাতে কি, রানও যে হতে থাকে। টি২০ বিশ্বকাপ এ নিয়ে ষষ্ঠবার হচ্ছে। আগের পাঁচবারই পাকিস্তান দেখায় ঝলক। যতই দুর্ভিক্ষ লেগে থাকুক দলে, বিশ্বকাপ আসলেই যেন তরতাজা হয়ে ওঠে দল। এবার যেমন এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলতে পারেনি। এরআগেও হারই শুধু যুক্ত হয়। কিন্তু বিশ্বকাপ আসতেই ২০০৭ সালের রানার্সআপ, ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন, ২০১০ ও ২০১২ সালের সেমিফাইনালিস্ট ও ২০১৪ সালে ‘সুপার টেনে’ খেলা পাকিস্তান জ্বলে ওঠে। আফ্রিদি যে কি মারমুখি হয়ে খেলা শুরু করেন। যেন সর্বশেষ দুইবার যে বাংলাদেশের কাছে টি২০তে হেরেছে পাকিস্তান, সেই প্রতিশোধ নিতেই নামেন। ভারতের মাটিতে প্রথমবার বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার সুযোগটি যেন পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ফেলেন। ১৯ বলে চারটি চার ও চারটি ছক্কা হাঁকিয়ে তাসকিনের বলে আউট হন। ততক্ষণে পাকিস্তানের স্কোর ১৯৮ রানে চলে যায়। পাকিস্তান ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ২০১ রান করে পাকিস্তান। যা বাংলাদেশ টপকে যাবে, তা শুধু স্বপ্নেই ভাবা যায়। বাস্তবতায় এর কোন স্থানই নাই। ২০০৮ সালে করাচীতে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ২০৩ রান করেছিল পাকিস্তান, তা থেকে এবার ২ রান কম করল। যা পাকিস্তানের টি২০তে দ্বিতীয় সেরা স্কোর। ইডেন গার্ডেনে এটি আবার এখন পর্যন্ত সেরা স্কোর। টি২০ বিশ্বকাপেও এটি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ স্কোর। সেই স্কোরের সামনে বাংলদেশ ব্যাটসম্যানরা হাবুডুবু খেয়েছে। তাতে করে হারও হয়েছে বলতে গেলে বড় ব্যবধানেই। বাংলাদেশের শুভ সূচনার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে টি২০ বিশ্বকাপ প্রথম ম্যাচেই জয় তুলে নিল পাকিস্তানও।
×