ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদত্যাগ যথেষ্ট নয়

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১৭ মার্চ ২০১৬

পদত্যাগ যথেষ্ট নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রিজার্ভের অর্থ চুরি যাওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ বা অব্যাহতিকেই যথেষ্ট সমাধান হিসেবে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই পদত্যাগের মাধ্যমে ঘটনার দায়মুক্তি সম্ভব নয়। অর্থ চুরি বা জালিয়াতির ঘটনা ঠেকাতে নতুন গবর্নরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আর্থিক নিরাপত্তা ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা দরকার বলেও মনে করছেন তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লোপাটের ঘটনার পর গবর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগকে ইতিবাচক এবং দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা পদত্যাগের ঘটনাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন, এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও গতিশীল হবে। নতুন গবনর্রকে দ্রুত পরিবর্তনশীল তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে বলেও মনে করেন তারা। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নরের পদ থেকে ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ অন্যদিকে দুই ডেপুটি গবর্নর নাজনীন সুলতানা ও মোঃ আবুল কাশেমকে তাদের পদ থেকে দেয়া হয় অব্যাহতি। একই ঘটনায় ওএসডি করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমকেও। তবে এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ বা অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের আর্থিক ঝুঁকি কমানো বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পদত্যাগের মাধ্যমে এ ঘটনায় দায়মুক্তি ঘটবে না উল্লেখ করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলছেন তারা। অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী যারা ওই বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বলির পাঠা বানানো হবে বা দায়মুক্ত করা হবে। এই রকম একটা যদি উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঠেলে দেয়া হবে। যদি এটার যথাযথ অনুসন্ধান ও বিচার করা না হয়। তাহলে এ অরক্ষিত অবস্থা একটা ভয়ঙ্কর পর্যায়ের দিকে চলে যাবে। রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর নতুন গবর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন সাবেক অর্থসচিব ও সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবির। নিয়োগ দেয়া হবে নতুন ডেপুটি গবর্নরও। ব্যাংকিং চ্যানেলের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কিছু দিন আগে তার এ ধরনের বিদায়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন অর্থনীতিবিদ কে এস মুর্শিদ। তিনি বলেন, দায়-দায়িত্ব ড. আতিউর রহমান স্বীকার করে নিয়েছেন, আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে বিরল। আমি আশা করব ওনার এ পথ অনুসরণ করে আরও অনেকের পদত্যাগ করা উচিত। উনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। ভাল কাজ করেছেন, সুনাম কুড়িয়েছেন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই-তিন মাস আগে এই পরিস্থিতিতে তাকে চলে যেতে হচ্ছে, এটা আমি মনে করি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তবে সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া সঙ্কট মোকাবেলায় এ ধরনের পরিবর্তন বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও গতিশীল করবে বলে মনে করছেন ব্যাংক বিশ্লেষক মামুন রশিদ। তার মতে, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য ইতিবাচক যে কোন সিদ্ধান্তকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ বলেন, গবর্নর যিনিই হোন না কেন বাইরের চেয়ে তার উচিত ভেতরে বেশি নজর দেয়া। যাতে করে নিত্যনতুন নিয়মকানুন আধুনিকায়নের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সমাজকে সাহায্য করতে পারে। চেইন অব কমান্ড যাতে কেউ ব্রেক করতে না পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য প্রয়োজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে অপরাপর স্টেকহোল্ডার তাদের সঙ্গে কাজ করে এটা করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কোন ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চাপের উর্ধে উঠে দেশের স্বার্থেই নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তদের শক্ত হাতে নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানালেন অর্থনীতির এই বিশ্লেষক। অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সিস্টেমের কোন কোন জায়গায় উন্নত করা দরকার। ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যেই কাজগুলো করা দরকার, সে জন্য যা যা পরিবর্তন আনা দরকার সেগুলো করতে হবে। আর আর্থিক-খাত এবং ব্যাংকিং-খাতে বা বিভিন্ন লেনদেনের সঙ্গে যারা জড়িত। তাদের জন্য একটা সাইবার নীতিমালা প্রয়োজন। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা আর্থিক বরাদ্দ রাখতে হবে।’ এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে অর্থ-মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশনের কার্যপরিধির আওতা বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের কথাও বলছেন তারা।
×