ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

২০২১ সালের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৭ মার্চ ২০১৬

২০২১ সালের বাংলাদেশ

(শেষাংশ) অফিস-আদালতের সর্বস্তরে বাংলা চালুর বিষয়ে আরও জোরদার অগ্রগতির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশের কোর্ট-কাছারিতে বাংলা ভাষা চালু হয়ে গেলেও উচ্চতর ন্যায়ালয়ে এখনো ইংরেজী ভাষায় রায় ঘোষণা করা হয়। আগামী পাঁচ বছরে ২০২১ সাল নাগাদ সব আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার বিধান চালু করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে যে সকল রায়ের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে সেগুলো সম্ভবত ইংরেজীতে লিখতে হবে। এছাড়া আইনের বইগুলোকে বাংলায় রূপান্তর করতে হবে। দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম অফিসিয়ালি মূলত বাংলা হলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি, মেডিক্যাল এবং অন্যান্য শিক্ষার মাধ্যম এখনও ইংরেজী। এক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় আরও ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে, ইংরেজী বা অনুরূপ অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত ভাষা এখন শুধুই একটি ভাষা নয়, বরং এর গুরুত্ব এখন টেকনোলজি, এমনকি উৎপাদনের উপাদানের (ভধপঃড়ৎ ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ) মতো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে ইংরেজী ভাষার সকল প্রয়োজনীয় মূল জ্ঞানের আধার বইসমূহকে প্রথমেই বাংলায় অনুবাদ করে নিতে হবে। নইলে দর্শন, ইতিহাস, গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে যে জ্ঞানভা-ার ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী ভাষার বইতে সংরক্ষিত রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত রেখে উচ্চশিক্ষার্থীগণকে সত্যিকারভাবে জ্ঞানী করে তোলা যাবে না। তাই ২০২১ সালের মধ্যে বিদেশী ভাষার বইসমূহকে বাংলায় অনুবাদ করে এবং বাংলা ভাষায় মূল বই প্রণয়ন করিয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রচলন বাধ্যতামূলক করার পথ করা যেতে পারে। শেষের কথা বাংলাদেশ সার্ভে অব পাবলিক ওপিনিয়ন শিরোনামে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য জরিপ প্রতিষ্ঠান নিয়েলসন বাংলাদেশকে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা চালিয়েছে। দৈবচয়নে ২৫৫০ জন উত্তরদাতার কাছ থেকে ৩০ অক্টোবর হতে ১৯ নবেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রশ্নোত্তর চাওয়া হয় সারাদেশে। তার মধ্যে শতকরা ৪৩ জন উত্তর দেন। সমীক্ষার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছে বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত উপাদান পাওয়া যায়। দেশ সঠিক পথে নাকি বেঠিক পথে চালিত হচ্ছে এরকম প্রশ্নের জবাবে নবেম্বর ২০১৩ তারিখে ৩৩% উত্তরদাতা সঠিক পথে ও ৬২% বেঠিক পথের মূল্যায়ন দিয়েছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় নবেম্বর ২০১৫ তারিখে সঠিকের অনুপাত ৬৪ ভাগে উঠে আসে এবং বেঠিকের অনুপাত নামতে নামতে শতকরা ৩২ ভাগে হ্রাস পায়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্প্রতি সঠিক পথে চলার মূল্যায়নকারী উত্তরদাতাগণ এর জন্য শিক্ষার অগ্রগতিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন (শতকরা ৭২ জন)। আর বেঠিক পথে চলার উত্তরদাতাগণের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগ দায়ী করেছেন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে। তবে মাত্র শতকরা এক ভাগ মনে করেন যে, একতরফা সরকার এ জন্য দায়ী। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভাল ও মোটামুটি ভাল হিসেবে শতকরা ৬৭ জন মত দিলেও নবেম্বর ২০১৫ সালে এটি বেড়ে শতকরা ৮০ ভাগে উঠে আসে। রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত স্থিতিশীল ও মোটামুটি স্থিতিশীল সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে ছিল শতকরা ৫৯, আর নবেম্বর ২০১৫-তে এটা বেড়ে শতকরা ৭০-এ উঠে আসে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করছেন ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী, যা নবেম্বর ২০১৫ সালে ছিল শতকরা ৭৯ ভাগ, আর গত এক বছরে অবস্থার উন্নতি দেখছেন শতকরা ৬৫ জন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বনাম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিতর্কে গণতন্ত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা উত্তরদাতাগণের পরিমাণ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে ছিল ৫৮ ভাগ, আর নবেম্বর ২০১৫-তে এই অনুপাত শতকরা ৪৩ ভাগে নেমে আসে। সমৃদ্ধির স্বার্থে গণতন্ত্রের খানিকটা কমতি এখনও লোক মেনে নিচ্ছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ল অব দ্য সি ট্রাইব্যুনালে সমুদ্রসীমা জেতার পর এক লাখ উনিশ হাজার বর্গকিলোমিটারের কিছু বেশি এলাকা বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত হয়। মালিকানা মিলে সমুদ্রসীমা এবং মহীসোপানে। উন্মুক্ত হয়েছে সুনীল অর্থনীতি বিকাশ করে বিবিধ সম্পদ তেল, গ্যাস, অন্যান্য খনিজ, মৎস্য, ওষুধ প্রস্তুতের উপকরণ, জাহাজ চলাচল সুবিধা ও পর্যটনসম্ভার আহরণ করে দেশের উঠতি প্রবৃদ্ধির হারকে আরও বেগবান করা। এ জন্য অবশ্যই সমুদ্রসীমা পাহারা ও সংরক্ষণের জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অনেক শক্তি সংযুক্ত করতে হবে, ক্ষমতায়িত পরিকল্পনা কমিশনের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে সমন্বিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রোগ্রাম ও প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা জরুরী। উচ্চশিক্ষায় সুনীল অর্থনীতি বিষয়ের সকল দিক নিয়ে জ্ঞান আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। বিগত চার দশকে সমুদ্র ও উপকূল সীমানায় অনেক ভাঙ্গা-গড়ার নিট ফলশ্রুতিতে দশ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি সংযুক্ত হয়েছে বাংলার আয়তনে। প্রতি বছর এখনও ভূমিখ- জেগে উঠছে। এ বিষয়ে শ্রম, কৌশল, সম্পদ ও মনোযোগ দিতে পারলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক আয়তন আরও বেশ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। পৃথিবীর সর্বনি¤œ মাথাপিছু ভূমির দেশে নতুন এলাকা স্বস্তি আনবে এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ধারাতে যথেষ্ট অতিরিক্ত শক্তি যোগাতে পারবে বৈকি। দেশের পরম সৌভাগ্য, নেতৃত্ব যার হাতে তিনি জনস্রোতের উজানে গিয়ে জনমতধারাকে সম্পূর্ণভাবে ঘুরিয়ে দিয়ে তার পেছনে আনার ক্ষমতা রাখেন। সে উদ্ভাবনী বলিষ্ঠ নেতার অনুসারী হয়ে ২০২১ সালে সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও গৌরব মহিমার শিখরে আরও দৃঢ় পদক্ষেপে যাত্রার এখনই সময়। লেখক : সাবেক গবর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
×