ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৭ মার্চ ২০১৬

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

(১৬ মার্চের চতুরঙ্গ পাতার পর) এ সংখ্যায় বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ দেখছি না। কিন্তু, আশুগঞ্জ থেকে পাঠানো একটি রিপোর্ট দেখছি। তিনি লিখেছেন (প্রেরকের নাম নেই)। “আশুগঞ্জ বিশ্ব গুদাম। হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। উক্ত গুদামে ৮০/৯০ জন যুবতী মেয়েকে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে। তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। অনেকেই গর্ভবর্তী। কিছু মেয়ের নাম জোগাড় হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণ, বয়স আনুমানিক। আরও অনেকের নাম জোগাড় করা যায়নি। ঘটনাবলী (এই শিরোনামে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। হাতের লেখা দেখে মনে হয় এটি কোন মহিলা লিখেছিলেন।) যাত্রাপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মেয়েকে ২৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। তার মুখ থেকে শোনা ঘটনা। হানাদার ২ জন সৈনিক ১০ বছরের একটি সুন্দরী মেয়েকে ছিনিয়ে এনেছে শ্লীতাহানির জন্য। মেয়েটিকে উলঙ্গ করার পর দেখা গেল যে তার যোনিদ্বার এত ছোট যে, তাদের আশা চরিতার্থ করার কোন সম্ভাবনা নেই। ২ জুনই [জন] তখন ভাবনায় পড়লেন। কী করা যায়। ফট করে একজন বুদ্ধি দিলেন যে, যোনিদ্বার কেটে বড় করে নেয়া যেতে পারে। ভাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ। বেয়নেট দ্বারা মেয়েটির যোনিদ্বার কেটে নিলেন একজন। পরে দুইজন তাদের পাশবিক আশা মিটালেন। বলা বাহুল্য মেয়েটি বেঁচে নেই। তার লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য বলাৎকার করার পর অসংখ্য মেয়েকে মেরে মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বগুদামের একটি ঘরে ১০/১২ জন বন্দিকে এনে দাঁড় করানো হলো। কিছুক্ষণ পরেই জনৈকা উলঙ্গ যুবতী মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। শফী নামক কলেজের জনৈক বন্দী ছাত্রকে উক্ত ঘরেই সকলের সামনে উক্ত যুবতীর উপর পাশবিক অত্যাচার করতে বাধ্য করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে উক্ত যুবতী নারীর উপর বলাৎকারের অপরাধে শফির বিচার হলো সকলের সামনে। অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় শফির প্রাণদণ্ড হলো। ঐ ঘরেই একটি পাথরের উপর শফির পুরুষাঙ্গ রেখে অন্য একটি পাথর দ্বারা আঘাত করে তাকে হত্যা করা হলো। আর সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হলো, যখন পর পুরুষের সঙ্গে সহবাসের অপরাধে উক্ত যুবতী তারার বিচার প্রহসন হলো। তারার যোনিদ্বারে আস্ত কচু ঢুকিয়ে দেয়া হলো। এবং লোহার রড দিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা ধীরে ধীরে অপনাদের জানাব। এবার অজানা কিছু ঘটনা বলি এটিকে রিপোর্ট কাম চিঠি হিসেবে ধরতে পারেন। প্রথমাংশে তিনি এলাকার কথা জানিয়েছেন। নিজের হতাশার কথা বলেছেন। পরের অংশটি রিপোর্ট। আশুগঞ্জ বাজারে কোনো মানুষ নেই বললেই চলে। সরকার পক্ষ অনেক চেষ্টা করেও বাজার বসাতে পারেননি। আশুগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত রেল লাইনের পাড়ে পাড়ে যত বাড়ি ছিল সব পুড়েছে। অবশ্য এখন কোন চিহ্নই দেখতে পাবেন না। কেননা সবাইকে নতুন টিন দ্বারা বাড়ি পুনঃনির্মাণ করতে বাধ্য করেছে। জমি বিক্রয় করে মানুষ নতুন টিন দ্বারা বাড়ি করেছে। যাদের বিক্রির মতো জমিও নেই, তারা পালিয়ে বেঁচেছে। অবশ্য জমি কেনে কে? হাজার টাকার জমি একশত টাকায় বিক্রয় হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থার কথা নাইবা বললাম। জমি ভরা ধান, কিন্তু ঘরে অনেকের যুদ্ধ চলছে, মুখোমুখি, পালিয়ে পালিয়ে। জনতার সঙ্গে যোগাযোগ? নেই বললেই চলে। বড় শরিকেরা খাতা (খুব সম্ভব আওয়ামী লীগ) ব্যবহার করে। সংগঠন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি কই। আমাদের কয়েকটা গ্রুপ আছে। কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক কিছুই হচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, কার জন্য সংগ্রাম? জনতার জন্য? আমরা তো জনতার বিপদের মাত্রা কমাতে পারছি না। বরং বাড়াতেই পারছি। বড় অভাবে আছি। কিছু পয়সা, ওষুধ, কাপড় দরকার। কাপড়ের মধ্যে লুঙ্গি, গামছা, শার্ট ও গরম কাপড় হলে ভালো। নগদ পয়সা মোটেই নেই। পাব কোথায়? জনতার হাতে পয়সা থাকলে তো আমাদের হাতে থাকবে। তারপর কিছু গ্রাম বিষয়ক তথ্য আশুগঞ্জ ইউনিয়নের। ॥ সাত ॥ খোদাদাদ বলছিলেন, ঢাকা ও আশপাশে স্বাধীনতা বিলি করার পর খুবই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন-“অফিস থেকে বেরোবার মুখে অনুর (আনোয়ারুল ইসলাম) সঙ্গে দেখা। অনু বললেন, ডাক্তার (মনিরুজ্জামান) একটা গোপন পত্রিকা বিলি করছে। পড়বেন? বললাম, কী? অনু ফের বললেন, স্বাধীনতা। বললাম, দেবেন। ভালো লাগল। সংগঠনটা দানা বাঁধছে। প্রতিরোধের মূল শর্ত : গোপনীয়তা : তাই মেনে কাজ চলছে।” তৃতীয় সংখ্যার মূল প্রবন্ধ ‘জঙ্গীশাহীর আর্থিক বুনিয়াদ ধ্বসে পড়েছে!! ” তারপরের শিরোনাম ‘না, না, না?’- “মুজিবনগর ১৩ ভাদ্র : যাদের অস্ত্রে বাঙালীদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই নাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে সাক্ষাৎদানে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে এ কথা বলেছেন বলে এখানকার কূটনৈতিক মহলে প্রকাশ। মি. ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিশেষ দূত কিসিঞ্জারের পাকিস্তান সফরকালে একমাস পরে গতমাসের শেষ সপ্তাহে একবার বঙ্গবন্ধুকে এ প্রস্তাব দেন। প্রকাশ, এ ধরীবাজটির সাহায্যেই নর পিশাচ ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর মন গলানোর চেষ্টা করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই ইয়াহিয়ার কসাই বাহিনীর অস্ত্র সরবরাহ করছে।” সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ‘যে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।’ ‘হায় ধর্ম!’ নামে ছোট একটি নিবন্ধ আছে। তারপর ‘মুক্তিবাহিনী সমাচার’ মুক্তিবাহিনী সমাচার বাংলাদেশের বিস্তৃত রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বিপুল সাফল্যের সংবাদ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, গত ২২ সেপ্টেম্বর মিরেশ্বরাইয়ে ৩০ ঘণ্টা স্থায়ী এক সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৬৯ জন সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কুতুবদিয়ার বাতিঘরটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং চট্টগ্রাম বন্দরে কটি মার্কিন জাহাজের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে। চট্টলা শহরের অন্দর কিল্লায় এক সংঘর্ষে ১৩ জন রাজাকারের একটি দলকে পযর্ুুদস্ত করেছে। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর খবরে গতকাল প্রকাশ সন্দীপ প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চলগুলোতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। হাতীয়ায় ১৪৫ জন রাজাকার ট্রেনিং নিয়েছিল কিন্তু মাইনে না পাওয়ায় তারা বিদ্রোহী হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কুমিল্লা জেলায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নবীনগরের কাছে বিটঘরের এক সংঘর্ষে ২৫ জন খান সেনা নিহত হয়েছে। নোয়াখালীতে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক হারে দালালদের খতম করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। লক্ষীপুরে এক সংঘর্ষে ৮ জন খান সেনা ও ১৭ জন রাজাকার নিহত হয়েছে, বহু আহত হয়েছে। ময়মনসিংহের বিস্তৃর্ণ এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। সম্প্রতি সিলেটে এক সংঘর্ষে ১৬০ জন খান সেনা ও রাজাকার নিহত হয়েছে। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের অদূরে এক সংঘর্ষে ২৯ জন খান সেনা নিহত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, কিছুদিন পূর্বে যমুনা নদীতে মুক্তিবাহিনী একটি অস্ত্রবাহী জাহাজকে ধ্বংস করে এবং তার সমুদয় অস্ত্র দখল করে। আনসার আলী নামক জনৈক প্রাক্তন চেয়ারম্যান (দালাল) এর নেতৃত্বে একটি ভুয়া মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। তারা লুঠতরাজ ও অসামাজিক কার্যকলাপ করতে থাকলে পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর বীরেরা তাদের গ্রেফতার করে। গণআদালতে বিচার করে দালাল আনসার আলীকে মৃত্যুদণ্ড ও কয়েকজন সাথীকে বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত করে। উত্তর বঙ্গের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষে খান সেনারা নাস্তানাবুদ হয়েছে। তালতলা, গালিমপুর, জয়পাড়া, কলাকোপা-বান্দুরা এবং নারায়ণগঞ্জের আশপাশের এলাকা উল্লেখযোগ্য। ঢাকা শহরেও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দালাল-মন্ত্রী ইসাক মিয়ার গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ উল্লেখযোগ্য। তিরিশে সেপ্টেম্বর সকালে কল্যাণপুরের পাহারারত রাজাকার বাহিনীর উপর হামলাও উল্লেখ্য। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুরা খবর না পৌঁছায় বিস্তারিত খবরাখবর দেওয়া গেল না। বরিশাল, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলাগুলো থেকেও খান সেনাদের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মোদ্দা কথা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি দুর্গ বিশেষ। এবং প্রতিনিয়ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত গতিতে বিস্তৃত হচ্ছে। স্বাধীন ও নতুন বাংলা গড়িয়া তুলুন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” ॥ আট ॥ চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ২৮ আশ্বিন ১৩৭৮। এ সংখ্যার শিরোনাম ‘মুক্তি সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।’ সেখানে জানানো হয়েছে নরখাদক টিক্কা খাঁর জায়গায় “বেসামরিক” দাঁতের ডাক্তারকে গভর্নর করে জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি বরং টিক্কার বিদায়ে মুক্তি সংগ্রামের সংকল্পকে দৃঢ়তর করেছে। বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষক, মজুর, ছাত্র খান সেনাদের আক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে বর্তমানে সংগঠিতভাবে পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করেছে। মুক্তি সংগ্রাম আজ এক নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে। গোড়ার দিকে সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত শত্রুবাহিনীর জল, স্থল, আকাশপথে আক্রমণের মুখে নিরস্ত্র বাঙালি লাখোলাখো প্রাণ দিয়েছিল, মুক্তিসেনারা পিছু হটে এসেছিল। কিন্তু সে ছিল সংগ্রামের সবে শুরু। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাঙালি জাতিকে পদানত করবে বলে যারা তড়পাচ্ছিল, ভেতো বাঙালির মারের চোটে বর্তমানে তাদের আরাম হারাম হয়ে গেছে। মুক্তিসেনারা প্রাথমিক বিপর্যয়ের পর নিজেদের পুনর্গঠিত করে খান সেনাদের নাস্তানাবুদ করে তুলেছে। বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের সাতানব্বই থানা কার্যত পাকফৌজ মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বৃহত্তম সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। চলবে...
×