ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে নজরদারিতে আনা হচ্ছে

ব্যাংক সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৬ মার্চ ২০১৬

ব্যাংক সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

এম শাহজাহান ॥ বিনিয়োগের খরা কাটাতে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চমাত্রার সুদ হার কমানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে ব্যাংক সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে উচ্চমাত্রার সুদ আদায় করছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। তাই বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোকে নজরদারির মধ্যে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি এবার সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার নির্ধারণে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের সুদ হার কমে যাওয়ায় এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। ইতোমধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংক ঋণের বিপরীতে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ সুদ আদায় করছে। ব্যাংকটি ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে তা ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে বিতরণ করছে। অর্থাৎ এই ব্যাংকের স্প্রেড হচ্ছে ২ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট। সোনালী ব্যাংকের মতো সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করছে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। শীঘ্রই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা এবং রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। জানা গেছে, এ মুহূর্তে বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে উচ্চ মাত্রার ব্যাংক ঋণের সুদ হার। শিল্পোদ্যোক্তারাও বলছেন, ঋণের বিপরীতে এত বেশি সুদ নেয়া হচ্ছে যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে টিকে থাকাটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় সুদ হার কমানোর কথা বলছেন তারা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশে সরকারী-বেসরকারী এবং বিদেশী ব্যাংক আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ আদায় করছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। বেসরকারী খাতের দ্য ফার্মারস ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড উচ্চহারে সুদ আদায় করছে। সুদ আদায়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদেশী ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ট ব্যাংক গলাকাটা সুদ ও সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। কমানো হলো আমানতের সুদ হার ॥ ঋণের বিপরীতে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে মেয়াদী আমানতের সুদ হার কমিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। মেয়াদী আমানতের সুদ হার দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে, যা গত ৩ মার্চ থেকে কার্যকর করেছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এখন মেয়াদী আমানতে আমানতকারীরা রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ পাবেন। আশা করা হচ্ছে, এই উদ্যোগের ফলে ঋণের সুদ হারও কমে আসবে। মেয়াদী আমানতের সুদ হার কমানোর কারণ জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদউদ্দিন বলেন, আমানতের সুদ হার কমানোর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। সম্প্রতি মূল্যষ্ফীতি কমেছে। আমরা (ব্যাংকগুলো) ঋণের সুদ হারও কমিয়েছি। যে কারণে আমানতের সুদ হার কমানো হলো। বিনিয়োগের সুযোগও বর্তমানে কম জানিয়ে তিনি বলেন, উচ্চহারে আমানত নিয়ে তা অলস বসিয়ে রাখা ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। আমানতের সুদ হার কমানোর এটিও একটি কারণ। নতুন সুদ হার অনুযায়ী ৩ মাস বা তার বেশি কিন্তু ছয় মাসের কম, এমন আমানতের বেলায় সুদ হার ১ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব বাড়ছে ॥ বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সুদ হার কমানোর দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতদিন ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে ১৯-২৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করেছে। উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এই বাস্তবতায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ব্যাংক সুদ কমানোর বিষয়ে কাজ শুরু করা হয়েছিল। এখন কমছে সুদ হার। এ কারণে গত বছরের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) সময়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাবের নিবন্ধন বেড়েছে। তবে কমেছে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রস্তাব নিবন্ধন। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মোট ৪০২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করেছে। এর মধ্যে ৩৭৬টি স্থানীয় এবং ২৬টি বিদেশী। নিবন্ধন নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান মোট ২১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এতে ৫৬ হাজার ২১৬ জনের কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় ৩৭৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনে ২০ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদেশী ২৬টির নিবন্ধনে বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার। এর আগের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩৭২টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়, যারা প্রস্তাব করে ১৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বিনিয়োগের। সে সময় স্থানীয় ৩৩২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনে ১৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়। আর বিদেশী ৪০টির নিবন্ধনে বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ৮৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকার। এদিকে অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে প্রকৌশল শিল্প খাতে, যা মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের ২৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ সময়ে রসায়ন শিল্প খাতে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশ, সেবা খাতে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ ও কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতে ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বাকি ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন শিল্প খাতে। বিনিয়োগ বাড়াতে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার দাবি উদ্যোক্তাদের ॥ বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ঋণের বিপরীতে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে বলে দাবি করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। সম্প্রতি এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে আনুষ্ঠানিকভাবে সুদ হার কমানোর দাবি জানিয়েছে। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে (৯ শতাংশের মধ্যে) নামিয়ে আনতে হবে। সেই সঙ্গে কোম্পানির আর্থিক টার্নওভার (লেনদেন) অনুসারে ঋণের সীমা নির্ধারণ চেয়েছেন তিনি। বিভিন্ন মহল থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এখনও সবচেয়ে বড় বাধা। এ সুদের হারে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা যায় না। তাই সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনা জরুরী হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে খেলাপী ঋণ কমাতে হবে। এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা) খাত উন্নয়ন, মহিলা উদ্যোক্তাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে টার্নওভার অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
×