ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৬ মার্চ ২০১৬

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

(১৫ মার্চের পর) নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ থানার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন এ হিসাব একেবারে নিখুঁত তা বলব না। যুদ্ধের হিসাব কখনও নিখুঁত হয় না। তবে কাছাকাছি বলতে পারি। এ হিসাবের মধ্যে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী স্ট্র্যাটেজির একটি চিত্র পাই। শেষ দু’টি গ্রামের উল্লেখ করতে পারি উদাহরণ স্বরূপ। এগুলো ঢাকা/নারায়ণগঞ্জের কাছাকাছি। স্থল বা জলপথে পৌঁছানো যায়। সৈন্যরা তিনটি গ্রাম সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছিল। যেসব এলাকা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল তাতে মৃতের সংখ্যা বেশি। এখানে মৃত্যুর যে সংখ্যা দেয়া হয়েছে তা আনুমানিক। কিন্তু মানুষের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। মরিচার টেকে ৭১০ জনের মধ্যে ৪০ জন নিহত। বাকিরা? ধরে নিতে পারি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। এদের অনেকে আবার পথে নিহত হয়েছেন। সে সংখ্যা হিসেবের মধ্যে নেই। পুরো বাংলাদেশে প্যাটার্নটা ছিল একই রকম। এক এলাকা থেকে মানুষ পালিয়ে আরেক এলাকায় যাচ্ছেন এবং পথে নিহত হচ্ছেন। অধিকাংশ গ্রামেই আগুন লাগিয়ে সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আমরা এখন বলি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তখন পরবর্তী প্রজন্ম বিষয়টি ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। এই হিসাব থেকে বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে। আরো কয়েকটি গ্রামের হিসাব পাওয়া গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের তালিকা দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে কারা শহীদ হয়েছিলেন কীভাবে তার তথ্যও পাই (পরিশিষ্ট-১) এরা হলেন জি সি দেব, মোঃ মনিরুজ্জামান, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মোঃ মুকতাদির, মোঃ সাদেক, ফজলুর রহমান খান, এ আর খান খাদেম, শাফাত আলী এবং সাদাত আলী। শহীদ পরিবারের জন্য কিছু অর্থও জোগাড় করা হয়েছিল। চাঁদা তোলা হয়েছিল ১০৫০। এর মধ্যে গিয়াস স্যার দিয়েছিলেন ৫০ টাকা। যাদের সাহায্য দেয়া হয়েছিল তারা হলেন মিসেস মুকতাদির ৩০০ শামসু (ইন্টারন্যাশনাল হল) ৫০ মিসেস সাদাত আলী ৩০০ পিয়ার মোহাম্মদ (রেজিস্ট্রার অফিস) ৫০ নমি (রোকেয়া হল) ৫০ খালেক (ঐ) ৫০ চুন্নু (ঐ) ৫০ শহীদ শরাফাত আলীর ভাইকে ১০০ টাকার পরিমাণ অতি সামান্য। কিন্তু এই সামান্য সাহায্য অনেককে বাঁচতে সহায়তা করেছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা তখন এমন যে, বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মারা গেলে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যেত। সঞ্চয় কারো প্রায় কিছু ছিল না। বাংলাদেশে এভাবে ৩০ লাখ পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যেমন হাতে লেখা একটি কাগজে উল্লেখ করা হয়েছে অঙ্কের লেকচারার শহীদ শারাফাত আলীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তার বাবাসহ ৭ জন। বাড়ির ঠিকানা-দক্ষিণ রায়পুর, পোঃ আমেদ নগর, থানা-কোতোয়ালী, কুমিল্লা। তার ভাই শহীদুল্লাহর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রতিরোধ গ্রুপ যোগাযোগ রাখতেন। আমাদের নির্মূল কমিটির সালমা হকের স্বামী ডা. হুমায়ুন কবিরকে হত্যা করা হয়েছিল। এই রিপোর্টটি তখন ছাপা হয়েছিল কিনা জানি না। তা তুলে দিচ্ছি- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দুইজন ডাক্তার হত্যা গত ১৫ নভেম্বর হাতীরপুল এলাকা থেকে ডাঃ আজহার আলী ও ডাঃ হুমায়ুন কবীরকে সকাল সাড়ে আটটার সময় কয়েকজন রাজাকার ও ওয়েস্ট পাকিস্তানী পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তারা সকালবেলা বাইরে যাওয়ার জন্য গলির মুখে আসলে কয়েকজন মুখে কালো কাপড় পরা ব্যক্তি তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। এদিকে আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে ছাড়ানোর জন্য সকল থানা ও মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে খোঁজ করে। কিন্তু থানা এবং আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে বলে যে তারা ঐরকম কোনো লোককে ধরেনি। পরদিন সকালবেলা মতিঝিল এলাকার ফকিরাপুলের নিচে ওই দুই ডাক্তারের মৃতদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু লাশ দেখে তাদের চেহারা চেনা যাচ্ছিল না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাদের দুইজনের পরনেই স্যুট ছিল। কিন্তুু মৃত্যুর পরে তাদের পরনে শুধু আন্ডারওয়ার আর ছেঁড়া শার্ট ছিল। তাদের সমস্ত শরীরে মারের চিহ্ন ছিল আর সারা মুখ বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো। ডাঃ আজহার আলী (বয়স অনুমান ৩৫ বছর) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজিস্ট ছিলেন আর হুমায়ুন কবীর এই বছরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হয়েছেন। ওদের দুইজনের বাড়িই ফরিদপুর। এর কিছুদিন পূর্বে একজন কুখ্যাত অবাঙালী মোটর ব্যবসায়ী খানকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করতে অকৃতকার্য হয়। সে তারপর থেকে ওই পাড়ার সকলের উপর অত্যাচার করতে থাকে একে ধরিয়ে দেয়, ওকে ধরিয়ে দেয়। আরেক ঘটনায় একজন অবাঙালী কম্পাউন্ডারকে মুক্তিবাহিনী মেরে ফেলে। খান সেই ঘটনায় বলেছিল যে, ওরা আমাদের একজন কম্পাউন্ডারকে মেরেছে। আমরা ওদের দুইজন ডাক্তার মেরে এর বদলা নেব। এখন সকলের ধারণা ওই দুইজন ডাক্তার হত্যার পিছনে ওই কুখ্যাত খানের ঘৃণ্য হাত আছে। ॥ ছয় ॥ স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংখ্যা নেই আমার কাছে। তবে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জার্নাল ৭১-’এ, সে সম্পর্কে তথ্য আছে। উদ্ধৃত হয়েছে মূল প্রবন্ধ “স্বাধীনতার’ দ্বিতীয় সংখ্যা বেরিয়েছে। এ সংখ্যায় আছে মূল প্রবন্ধ : দীর্ঘ মেয়াদী সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন; সম্পাদকীয় : দেশের জনগণই মূল শক্তি; বিশেষ প্রবন্ধ : রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি; জনযুদ্ধ, গণবাহিনী; রিলিফ নয় মৃত্যুবাণ; মুক্তিবাহিনী সমাচার। মূল প্রবন্ধে আমরা লিখেছি : বাংলাদেশের মানুষ আজ জাগ্রত। দুর্ধর্ষ ও নির্মম হত্যাকারীর বিরুদ্ধে সে আজ রুখে দাঁড়িয়েছে। তার সম্বল সামান্য কিছু অস্ত্র ও অগণিত মানুষ। এ সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের জয় অনিবার্য ও অবধারিত। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ হানাদারদের যতই অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুক না কেন, অন্যায় যুদ্ধে ওদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কারণ, প্রথমত এ যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী রূপ লাভ করেছে যা ইয়াহিয়া চক্র চায়নি। দ্বিতীয়ত হানাদারেরা সবদিক দিয়ে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত বাংলাদেশের এই ন্যায় সংগ্রামে বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি, বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রবর্গ বিশেষ করে রাশিয়া ক্রমেই সোচ্চার ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাকিস্তান মৃত।” চলবে...
×