ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার!

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৬ মার্চ ২০১৬

বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার!

ইতিহাস তার আপন গতিতে নিজস্ব কক্ষে প্রদক্ষিণ করে। কখনও হয়ত পেছনেও ঘোরে। কিংবা হয়ে ওঠে কখনও নির্মম। কিন্তু ইতিহাসের সত্য কোনভাবেই মুছে যায় না। বাঙালী ও বাংলার ইতিহাসে করুণ, যন্ত্রণাদায়ক ও নির্মম ঘটনাও ঘটেছে অতীতে। সেসব বিস্মৃত হবার নয়। প্রায় পৌনে তিন শ’ বছর আগে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করা হয়েছিল। বিদেশী বেনিয়াদের হাতে দেশকে তুলে দিতে স্বদেশী শাসকদের মধ্যে যারা সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, বাঙালী তাদের ঘৃণা করে আজও। তাদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। শীর্ষ বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মীরজাফরের নামটি এখনও বাঙালীর মন থেকে মুছে যায়নি। জালিয়াতি, শঠতা, দেশদ্রোহিতা, বেইমানি, ষড়যন্ত্র সর্বপ্রকার নীচ স্বার্থপরতার সম্মিলিত নাম মীরজাফর। উপমহাদেশের মানুষের কাছে আজও ধিকৃত চরিত্র সে। বিশ্বাসঘাতক শব্দটির আরেক নাম মীরজাফর। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে যে বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে, তা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। যুদ্ধক্ষেত্রেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ মীরজাফরকে নতুন নবাব হিসেবে অভিনন্দন ও কুর্নিশ জানিয়েছিল। যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতন ঘটেছিল তারই কারণে। পুরস্কার হিসেবে ইংরেজরা তাকে বাংলার মসনদে আরোহণের সুযোগ করে দেয়। নতুন নবাব হয়ে ইংরেজদের স্বার্থরক্ষায় বাংলার স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দিয়েছিল। মীরজাফর যুদ্ধে পরাজয়ের ক্ষেত্র শুধু তৈরি করেনি, কারারুদ্ধ সিরাজকে তার পুত্রের নির্দেশে হত্যা করা হয়। হত্যার পর মৃতদেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদের রাস্তায়ও ঘোরানো হয়েছিল। পলাশীর পরাজয় সকল ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রথম উপমহাদেশের সর্বাধিক সমৃদ্ধ অঞ্চল বিদেশী শক্তির পদানত হয়। ইংরেজ বণিকরা ক্রমান্বয়ে শাসকে পরিণক হয় এবং দুশ’ বছর শাসন করে। ইংরেজরা মীরজাফরকে মসনদে বসালেও সে যে অযোগ্য ও অপদার্থ ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার দেশদ্রোহিতার ফলেই বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষ ইংরেজের অধীন হয়। তাকে নামমাত্র নবাব করে ইংরেজরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রথমে দৃঢ় করে। পরে তাকে উচ্ছেদও করে। সিরাজ বাঙালী ছিলেন না। তবে ছিলেন বাঙালীর আপনজন ও দরদী। ভালবাসতেন বাংলা ও বাঙালীকে। এক সময় নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঢাকায় ছিলেন। তিনি বুঝেও ছিলেন, ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে বাংলাকে পদানত ও পরাধীন শুধু নয়; ক্ষমতার মসনদেও আসীন হতে চায়। ধিকৃত মীরজাফরের বংশধররা গ্লানি নিয়ে দিন কাটিয়ে আসছিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদের নবাবী খেতাব ফিরে পাবার জন্য তারা আদালতে দীর্ঘ আইনী লড়াই চালিয়ে আসছিল। তাতে তাদের জয় হয়েছে। তারা ফিরে পেয়েছে নবাবী খেতাব। কলকাতা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি পেল মীরজাফরের বংশধর সৈয়দ মোহাম্মদ আব্বাস আলী মির্জা পৌনে তিন শ’ বছর পর। আসলে বিশ্বাসঘাতকার পুরস্কার হিসেবেই লর্ড ক্লাইভ মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের নবাবের আসনে বসিয়েছিল। সেই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মীরজাফরের পরিবারকেই নবাবের স্বীকৃতি দিয়ে বছরে এক লাখ ৮৫ হাজার রুপী ভাতা বরাদ্দ করেছিল। আর সিরাজের স্ত্রী লুৎফাকে মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা বরাদ্দ করা হয়। সিরাজের মৃত্যুর পর থেকে তার পঞ্চম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারী কোন চাকরি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার। ষষ্ঠ বংশধরের চাকরির জন্য ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর অনুরোধে ডেপুটি সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। তার বংশধররা ঢাকায় বসবাস করেন। ১৯৬৯ সালে মীরজাফরের উত্তরসূরি মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব ওয়ারিশ অলি শাহ কলকাতায় মারা যাবার পর ভারত সরকার উত্তরসূরি জানার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার নবাবের সব সম্পত্তি অধিগ্রহণের পর নবাবী খেতাব হারায় মীরজাফরের উত্তরসূরিরা। খেতাব ফিরে পাবার জন্য উত্তরসূরিরা আদালতে লড়াই করে অবশেষে নবাবী খেতাব ফিরে পায়। ইতিহাসের কী নির্মম দিক যে, বিশ্বাসঘাতকের উত্তরসূরিরা পিতৃপুরুষের পদবি ফেরত পেল। স্বাধীন ভারতবর্ষে এটা কী করে সম্ভব হলো, তা ভাবার বিষয়। ইতিহাস আসলেই নির্মম।
×