ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১৫ মার্চ ২০১৬

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ

দুটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর একে অপরকে বৃত্তাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। দুটোই প্রায় এক শ’ কিলোমিটার চওড়া। একটির ভর হচ্ছে আমাদের সূর্যের ভরের ৩৬ গুণ। অন্যটির ভর ২৯ গুণ তারা এক কিলোমিটারের মতো ব্যবধানে এক কক্ষপক্ষীয় নৃত্যে আবদ্ধ। সেই নৃত্য এত দ্রুতগতিতে হচ্ছে সে তা আলোর গতিতে পৌঁছছে। ব্ল্যাকহোল দুটির ঘটনা দিগন্ত (বাবহঃ যড়ৎরুড়হ) বা যে বিন্দুতে কোন কিছু গেলে আর ফিরে আসে না- পরস্পরকে স্পর্শ করছে। হঠাৎ প্রচ- বিস্ফোরণ হলো এবং চোখের পলকে কোটি কোটি কিলোগ্রাম পদার্থ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর শেষে এলো শান্তভাব এবং এক সেকেন্ডের মধ্যে একটা বৃহত্তর ব্ল্যাকহোলের জন্ম হলো। অবশ্য এটা এমন এক ব্ল্যাকহোল যা তার অংশগুলোর সমষ্টির চেয়ে কম। কারণ তিনটি সূর্যের ভরের সমান পদার্থ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে এনার্জিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এনার্জির এই তরঙ্গ প্রসারিত হয়ে তাদের পথে স্থানসহ যা কিছু পেয়েছে সেগুলোকে সঙ্কুচিত করছে। দুই ব্ল্যাকহোলের একীভবনের শেষ পঞ্চম সেকেন্ডে ঠা-া হয়ে ঘনীভূত হয়ে পড়া ব্ল্যাকহোল মহাশূন্যে এনার্জি উগড়ে দিয়েছে। গোটা মহাবিশ্বের বাকি অংশ আলো, বেতার তরঙ্গ, রঞ্জনরশ্মি, গামারশ্মির আকারে সমষ্টিগতভাবে যে পরিমাণ এনার্জি বিকীরিত করেছে ঘনীভূত হয়ে আসা এই ব্ল্যাকহোল তার তুলনায় ৫০ গুণ বেশি এনার্জি বিকিরণ করেছে। এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৩০ কোটি বছর আগে। এতগুলো বছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পৃথিবীর এ্যাডভান্সড লেজার ইন্টার ফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভিটরি (লিগো) নামক মানমন্দিরে সেই সব মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ক্ষীণতম টুকরো ধরা পড়েছে। সেই তরঙ্গ টুকরোটির নাম দেয়া হয়েছে জিডব্লিউ ১৫০৯১৪। গত ১১ ফেব্রুয়ারির বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীর কাছে এই তরঙ্গ ধরা পড়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এটাই হলো প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করতে পেরেছেন। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে এবং ১৪শ’ বছর আগে মহাবিস্ফোরণের সময় সংঘটিত সেসব ঘটনা এখনও পর্যন্ত মানুষের চোখে অধরাই থেকে গেছে সেগুলো এক পলক উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণাটি উদ্ভূত হয়েছিল মহাকর্ষ সম্পর্কে এলবার্ট আইনস্টাইনের মৌলিক ব্যাখ্যা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জিডব্লিউ ১৫০৯১৪ আবিষ্কৃত হওয়ার ঠিক প্রায় এক শ’ বছর আগে আইনস্টাইন এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন যে, বস্তুর ভর (গধংং) তার চারপাশের স্থান ও কালকে বিকৃত করে দেয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হলে এরই প্রতিফল। অর্থাৎ বস্তুর ভরের দ্বারা বিকৃতপ্রাপ্ত স্থানকালের বক্রতা ধরে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে চলমান বস্তুসমূহের আচরণ। ধারণাটা সহজ-সরল। কিন্তু যে সমীকরণের মধ্য দিয়ে এটা এত গাণিতিক ওজন লাভ করে তার সমাধান করা নাটকীয় রকমের কঠিন। শুধুমাত্র কতিপয় আসন্ন মান নির্ধারণের মাধ্যমেই এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান হতে পারে। এমনি এক আসন্ন মানের ভিত্তিতে আইনস্টাইন এক বিদঘুটে সূত্রে উপনীত হয়েছিলেন। তাহল যে কোন দ্রুতিশীল বা বেগবর্ধনশীল ভর স্থানকালে তরঙ্গ সৃষ্টি করে।ৃ অমন একটা সূত্রে পৌঁছালেও আইনস্টাইন এই ধারণাটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এই বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। অনেক দোদুল্যমানতা দেখিয়েছেন। অনেক শব ব্যবচ্ছেদের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যেতে পারেননি। আইনস্টাইন ও তার সহকর্মীরা গণিত নিয়ে অনেক টানাহেঁচড়া করলেও অন্য গবেষকরা আবার বস্তুর প্রসারিত ও সঙ্কুচিত অবস্থায় অনুমিত তরঙ্গগুলো ধরার চেষ্টা করে গেছেন। তাদের সমস্যাটি ছিল এই যে, প্রত্যাশিত ফলটি বেশ কয়েক কিলোমিটার চওড়া একটি সঙ্গে একটা প্রোটনের সম্ভবত এক হাজার ভাগের এক ভাগ প্রস্থের সমান মাত্রায় একটি ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন। পরবর্তীকালে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের পরোক্ষ প্রমাণও পাওয়া যায়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো পরস্পরকে ঘুরপাক খেয়ে চলা পালসার নামে কয়েক জোড়া মৃত নক্ষত্র থেকে নির্গত বেতার তরঙ্গ পরিমাপ করা এবং তা থেকেই এই উপসংহারে পৌঁছান যে এরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মহাজগতে ছড়িয়ে দেয়ার সময় তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কিভাবে কমে আসছে। তবে লিগো নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বেতার তরঙ্গগুলো প্রহেশিকাময় হিসেবে প্রমাণিত হয়। তাদের ধরা যেত আবার যেত না। লিগো হচ্ছেÑ একটা ইন্টারকোরামিটার। এটা একটা লেজার কর্মীকে দুটি অংশে বিভক্ত করে কাজ করে। লিগো মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্তে সমস্ত তথ্যই জানা যায়। যেমন তরঙ্গে উৎস, এর সঙ্গে কি কি ভর সংশ্লিষ্ট এবং তরঙ্গের উৎসটি কত দূরে অবস্থিত। তবে লিগোতে যা দেখতে পাওয়া গেছে তা যে সত্যিই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সে সম্পর্কে একান্তভাবে নিশ্চিত হওয়বার জন্য প্রচুর খতুরান হতে হয়। লিগো প্রকৃতপক্ষে দুটি স্থাপনা। একটি লুইজিমায়ার, অন্যটি ওয়াশিংটন রাজ্যে। এই দুই স্থাপনায় কোনকিছু যখন প্রায় একইসঙ্গে ধরা পড়বে তলন সেটা সম্ভবত হয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সম্পর্কে আইনস্টাইন অনেক অনিশ্চিত ছিলেন। এর অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণিত হওয়ায় ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেল। শুধু তাই নয়, এর ফলে বিগব্যাংক বা মহাবিস্ফোরণেই ঘটনাও এক পলক দেখে নেয়া হয়ত সম্ভব হবে। কাজেই সে ঘটনার অতি ক্ষুদ্রাংশও যদি এক পলক দেখে নেয়া সম্ভব হয় তো মন্দ কি! সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×