ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকায় বরখাস্ত অবসরপ্রাপ্ত ও কারাবন্দীর নাম

রেলের বিসিএস ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতা নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১৫ মার্চ ২০১৬

রেলের বিসিএস ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতা নিয়ে নানা প্রশ্ন

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রেলের বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। কি কারণে তালিকায় বরখাস্ত হওয়া কারাবন্দী থেকে শুরু হওয়া অবসরপ্রাপ্ত এমনকি অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ২০০৯ সালে একই স্মারকে দুটি সিনিয়রিটি তালিকা করার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, সোমবার ডিজি আমজাদ হোসেন পদোন্নতি তালিকার সিনিয়রিটির তোয়াক্কা না করে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মোঃ সামসুজ্জামানকে এডিজি (আরএস) পদে চলতি দায়িত্ব দেয়ায় রেল ভবনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। রেল মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বিসিএস (প্রকৌশল, পরিবহন ও বাণিজ্যিক) ক্যাডার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে চলে নানা কারসাজি। প্রশ্ন উঠেছে মন্ত্রণালয়ের চাপের মুখে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে কিনা। যে তালিকা অনুযায়ী পদোন্নতিতে কারসাজি করা হচ্ছে সে তালিকায় রয়েছে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া পূর্বাঞ্চলীয় (বরখাস্ত) জিএম ইউসুফ আলী মৃধার নাম। এছাড়াও রয়েছে, বরখাস্ত, কর্মস্থলে অনুপস্থিত, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নাম। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে- তালিকা প্রণয়নের কর্ণধারের ভূমিকা নিয়ে। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, ২০১২ ও ২০১৪ সালের তালিকা গোপন করে ২০০৯ সালের একটি বিতর্কিত তালিকাকে প্রাধান্য দিয়ে সিনিয়রিটি অনুযায়ী পদোন্নতি খর্ব করা হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ২০০৯ সালে একই স্মারকে দুই ধরনের তালিকা প্রণয়নের অপচেষ্টা। এ ব্যাপারে রেলের ডিজি আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, সিনিয়রিটি অনুযায়ী রেলের পদোন্নতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা চিন্তা করলে হবে না। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বলে এডিজি (আরএস) হতে হয়। মোঃ সামসুজ্জামানকে এই পদের চলতি দায়িত্বে দেয়া হয়েছে। এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়ার প্রশ্নে ও জেডিজি কর্মকর্তাগণ থাকতে কেন প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়নকে) এ পদে চলতি দায়িত্বে দেয়া হয়েছে এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেডিজি ও প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) সমমর্যাদার পদ। তবে তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি কোন উত্তর দেননি। কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, যেসব কর্মকর্তা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এমনকি লবিং করতে অভ্যস্ত সেসব অসাধু কর্মকর্তার কারসাজিতে চলে তালিকা প্রণয়ন। ফলে সিনিয়রিটি অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন না হয়ে জুনিয়রকে সিনিয়র বানানোর অপতৎপরতা চলে। এক্ষেত্রে রেল মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ। প্রতি বছর সুষ্ঠু ও সুবিন্যস্ত এবং বিতর্কহীন তালিকা প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশ হচ্ছে না। ফলে জুনিয়ররা লবিংয়ের মাধ্যমে সিনিয়র হওয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও ডিজির দফতরে। প্রশ্ন উঠেছে, ২০১২ সালে অবসরে যাওয়া ও কারাবন্দী হওয়া কর্মকর্তা কিভাবে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা জ্যেষ্ঠতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। এমন যুগ্ম সচিব, অবসরপ্রাপ্ত, অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব, প্রেষণে থাকা কর্মস্থলে অনুপস্থিত, চাকরিচ্যুত বা স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৯২ জন কর্মকর্তার এমন তালিকা নিয়ে কর্মরতদের মধ্যে চলছে তোলপাড়। উল্লেখ্য, শুধু ২০১৪ সালই নয়, রেলের জন্মলগ্ন থেকে এমন অনিয়ম চলে আসছে বিসিএস ক্যাডারদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে একই স্মারকে দু’ধরনের দুটি তালিকা তৈরি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি ২০১২ সাল ও ২০১৪ সালের তালিকাতেও কি কারণে অবসরপ্রাপ্ত, চাকরিচ্যুত, কর্মস্থলে অনুপস্থিতদের নাম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর রেলের উপ পরিচালক (ই-২) হোসনে আরা আক্তারের পক্ষ থেকে প্রেরিত তালিকায় দেখা গেছে, নানা বিতর্কের মধ্যে রয়েছে রেলের জ্যেষ্ঠতা তালিকা। এ তালিকায় কমিটির তথ্য অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ চাকরিতে যোগদান, বয়স ও পদমর্যাদা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে হীন মনোভাব পোষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েক কর্মকর্তা। এছাড়াও কারাগারে অন্তরীণ ও ২০১২ সালে ৩শ’ কোটি টাকার রেলের নিয়োগ কেলেঙ্কারির দায়ে গ্রেফতার হওয়া ইউসুফ আলী মৃধা ওই তালিকায় ৭নং অবস্থানে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, একরামুর রহমান হিসেবে ১৯৭৯ সালের ১৬ অক্টোবর যোগদান করা সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী, যিনি যগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তার নামও রয়েছেন তালিকার ৮ নম্বরে। ১৯৭৯ সালের ২২ অক্টোবর সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করা প্রকৌশলী মোঃ আনিসুর রহমান, একই বছরের ৩ ডিসেম্বর যোগদান করা প্রকৌশলী সোলায়মান চৌধুরী, ১৮ অক্টোবর যোগদান করা সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ, ১২ অক্টোবর যোগদান করা সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কাশেম অবসরে গেলেও তাদের নাম রয়েছে জ্যেষ্ঠতার তালিকায়। অভিযোগ রয়েছে, জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) জ্যেষ্ঠতা বিধিমালা ১৯৯৩ অনুসরণ করার কথা। যেসব ক্ষেত্রে ওই বিধিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি সেক্ষেত্রে সাধারণ নীতিমালা ১৯৭০ অনুসরণ করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অবসরপ্রাপ্তদের তালিকা ও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত এমনকি সচিবালয়ে কর্মরতদের তালিকাও এই সমন্বিত তালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে জটিলতা সৃষ্টি করাসহ তালিকাটি বিতর্কিত করা হয়েছে। এ ধরনের তালিকা প্রণয়নকারী কমিটির এক সদস্য বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশকৃত কিন্তু রেলওয়ে সার্ভিসে যোগদান না করে থাকলে ওই কর্মকর্তাকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু একজন কর্মকর্তা রেলওয়ে সার্ভিসে যোগদান করে থাকলে এবং পরবর্তীতে পদত্যাগ, চাকরিচ্যুত, নিখোঁজ, অন্য ক্যাডারে যোগদান অথবা মৃত্যুজনিত কারণে রেল সার্ভিস ছেড়ে চলে গেলেও জ্যেষ্ঠতা তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
×