ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রফিক আজাদ সমাহিত

বিদায়বেলা কবি নিয়ে গেলেন উজাড় করা ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ মার্চ ২০১৬

বিদায়বেলা কবি নিয়ে গেলেন উজাড় করা ভালবাসা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ক্রান্তিকালে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন কবি। ভাষার অধিকারের দাবিতে নেমেছিলেন রাজপথে। কাব্যবীজের স্ফূরণে ভাষার মাঝে সঁপেছিলেন নবপ্রাণ। তাই তো বিদায়বেলায় নিয়ে গেলেন স্বজনসহ শুভানুধ্যায়ীদের উজাড় করা প্রাণের ভালবাসা। আপন কীর্তির মহিমায় পেলেন রাশি রাশি পুষ্পাঞ্জলি নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। এভাবেই নানা শ্রেণী-পেশার অজস্র মানুষের সম্মানকে সঙ্গী করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরবিদায় নিলেন স্বাধিকার আদায়ের কবি রফিক আজাদ। কবি, কবিতানুরাগী, স্বজন, সতীর্থ, চিত্রশিল্পী, মন্ত্রী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, প্রকাশকসহ সর্বসাধারণ জানালেন তাঁর প্রাপ্য বিদায়ী সম্মান। শেষ যাত্রায় বিশিষ্টজনদের জবানে উচ্চারিত হলো মুক্তিযোদ্ধা কবির দেশপ্রেম ও কবিতাকীর্তির কথা। তাঁকে নিয়ে শোক বইয়ে লেখা হলো শোকগাথা। সোমবার বসন্ত বিকেলে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় রফিক আজাদকে। এর আগে সকালে ও দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমি আঙিনায় কবিকে জানানো হয় দুই দফা শ্রদ্ধার্ঘ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম জানাজা। দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন হয় তাঁর ধানম-ির বাসভবনে। সকাল ১০টায় বারডেমের হিমাগার থেকে ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মারক শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় কবির মৃতদেহ। প্রাণহীন নিস্তব্ধ দেহখানি গ্রহণ করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ। মরদেহ রাখা হয় বেদির উল্টো পাশের গগন শিরীষ বৃক্ষের ছায়াতলে। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকা জেলা পরিষদের ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর মোহাম্মদ আমিনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল কবিকে প্রদান করে গার্ড অব অনার। বিউগলে ভেসে বেড়ায় করুণ সুর। লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় আবৃত করা হয় স্বদেশের প্রতি অন্তঃপ্রাণ কবিকে। সব শেষে শোক জানিয়ে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় কবির মরদেহের পাশে উপস্থিত ছিলেন জীবনসঙ্গী দিলারা হাফিজ, চার ছেলে অভিন্ন আজাদ, অব্যয় আজাদ, ইয়াসির রাহুল ও ইয়ামিন রাজীব, ভাতিজি নীরু শামসুন্নাহারসহ স্বজনরা। শহীদ মিনারে এই নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরুর কিছুক্ষণেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় কবিকে ধারণ করা কফিনটি। আর গগন শিরীষ গাছের ডান পাশে রাখা হয় শোক বই। মুক্তিযুদ্ধের কবিকে নিবেদিত অসংখ্য মানুষের শোকবাণীতে ভরে ওঠে একইসঙ্গে বেদনা ও ভালবাসার কথা বলা ওই খাতার পৃষ্ঠাগুলো। ব্যক্তিগতভাবে শহীদ মিনারে কবি রফিক আজাদকে শ্রদ্ধা জানান সৈয়দ শামসুল হক, এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, এমিরেটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, তিন চিত্রশিল্পী হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম ও নিসার হোসেন, কথাশিল্পী রশীদ হায়দার, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, কবি নাসির আহমেদ, কামাল চৌধুরী, সংসদ সদস্য কবি কাজী রোজী, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, কেন্দ্রীয় খেলা ঘরের একাংশের সভাপতি মাহফুজা খানম, জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে । সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়াকার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ছাত্র মৈত্রী, সরকারী তিতুমীর কলেজ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী, গ্রাম থিয়েটার, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, প্রান্তজনের সখা, যাত্রাশিল্পী উন্নয়ন পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, শিল্পিত, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, স্রোত আবৃত্তি সংসদ, বহ্নিশিখা, শ্রাবণ প্রকাশনী, পথনাটক পরিষদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় জাদুঘর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম, গীতিকবি পরিষদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থা, উদীচী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। কবির সহধর্মিণী দিলারা হাফিজ বলেন, আমি ঋষিতুল্য মানুষের সঙ্গে বাস করেছি। আমি একজন অতি ক্ষুদ্রতম মানুষ হয়ে প্রতিনিয়ত তাঁর কাছ থেকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা নিয়েছি। ধারণ করেছি দেশপ্রেম ও মানবিকবোধ। তিনি দেশকে এতটাই ভালবাসতেন যে সন্তানদের বলেছিলেন ‘তোদের প্রেমিকা থাকবে না, দেশই হবে তোদের প্রেমিকা’। ছেলে অভিন্ন আজাদ বলেন, পিতা হিসেবে তিনি আমাদের দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। সারাজীবন বলেছেন, দেশটাকে দেখে রাখিস। দেশের স্বাধীনতার জন্য কবিতার লেখার কলম রেখে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনে। তাঁর সেই রক্ত বইছে আমাদের ধমনীতে। সে শিক্ষায় দেশপ্রেম নিয়েই জীবনের বাকিটা পথ যেন পাড়ি দিতে পারি। আরেক ছেলে ইয়াসির রাহুল বলেন, শিল্পের মাধ্যমে তিনি যে সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন আমরা সেই স্বপ্নটাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চাই। কবির বড় ভাই নূরুল ইসলাম খান বলেন, আমার মা বাংলা বলতে পারতেন না। এজন্য তাঁর মধ্যে দুঃখবোধ ছিল। সেজন্য তিনি বলেছিলেন, রফিককে বাংলা সাহিত্যে পড়াব। মায়ের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেই রফিক হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন কবি। সৈয়দ শামসুল হক বলেন, কবির কখনও মৃত্যু নাই, কবিতারও মৃত্যু নেই। তারপরও ষাটের দশকের উজ্জ্বলতম কবি রফিক আজাদ ঝরে গেলেন। রয়ে যাবে তাঁর কবিতা। তিনি নিজেকে কৃষক বলে দাবি করতেন। তাই তার কবিতায় মাটি, মানুষ, উদ্ভিদ ও জনজীবন নিবিরভাবে লগ্ন হয়েছে। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, তিনি আমাদের সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একজন কবি। কবি পরিচয়ের বাইরে তাঁর বিশেষত্ব এই যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ ছিল। তার কবিতায়, ভাবনায় সে পরিচয় আমরা পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে রফিক আমার ছাত্র ছিল। আমার সামনে ওর চলে যাওয়া অনেক বেশি বেদনার। ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা কবি। তার কাছে যা অন্যায় মনে হয়েছে তা তিনি লিখেছেন। সেজন্য তাকে নিগৃহীতও হতে হয়েছে। যে বাংলাদেশের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, পরবর্তীকালেও সংগ্রাম করেছি; রফিক আজাদ সে সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক ছিলেন, আজীবন। রফিক আজাদের ‘জীবিত কবির চেয়ে মৃত কবি দামী’ উদ্ধৃতি চয়ন করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি কেন এ কথাটি লিখেছিলেন তা জানি না। কিন্তু তিনি জীবিত থাকবেন কবিতার মধ্য দিয়েই। যতদিন বাংলা কবিতা থাকবে, ততদিন তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে। আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠ। সবচেয়ে সক্রিয় ও অন্যতম কবি। প্রথম দিকে জীবনানন্দ দাশের ধারায় নৈরাশ্যবাদী কবিতা লিখেছেন। পরবর্তীতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর ভাবনা লেখার ধরন বদলে দেয়। তখনই তার কবিতায় জনগণের সংগ্রাম ও জাতীয়াতাবাদী চেতনা উঠে এসেছে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, স্বাধীনতার আগেই তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতা নিয়ে ভেবেছেন, যা স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত ছিল। তার কবিতায় তার দেশপ্রেম প্রতিফলিত হতো। তার দেহ চলে গেল, তবে লেখক-পাঠক-সাধারণ মানুষের হৃদয়ে থেকে যাবেন। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, তিনি তার কবিতা দিয়ে শিল্পী ও শিল্পকে প্রভাবিত করেছেন। তার মৃত্যুর পর আরও প্রবল হয়ে উঠবেন আমাদের শিল্প ও সাহিত্যে। আধুনিকতার নামে কবিতা যখন শিকড় থেকে সরে গেছে রফিক আজাদ তখন আধুনিক কবিতাকে প্রোথিত করেছেন স্বভূমিতে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, তার কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা কবিতা লেখা শিখেছি। কবিতাকে চিনেছি। রফিক আজাদকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আজীবন মনে রাখবে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে রশীদ হায়দার বলেন, আমি রফিকের মুখ দেখব না। তার আড্ডাবাজ, হুল্লোড়ময় মুখটাই আমার স্মৃতিতে বেঁচে থাক। মাহফুজা খানম বলেন, ব্যক্তিগত জীবনের মতোই রফিক আজাদের কবিতার মাঝেও ছিল সাহসিকতা। স্বাধীনতার মাস মার্চেই কবির বিদায় নেয়াটা তাই আমার কাছে হয়ে ওঠে তাৎপর্যপূর্ণ। বেলা ১টার পর কবির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। রাখা হয় একাডেমির নজরুল মঞ্চে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় বাংলা একাডেমি, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, অন্যদিন পরিবার প্রভৃতি। ব্যক্তিগতভাবে এখানে শ্রদ্ধা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আসাদ চৌধুরী, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। নির্মুলেন্দু গুণ বলেন, ষাটের দশকের কবিরা যে কাব্য আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সূচনালগ্নে পশ্চিমা কবিদের জীবনধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। বোহেমিয়ান সেই জীবনধারায় আমরাও অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। রফিক আজাদ তার কবিতাকে পদ্য-প্রবন্ধ বলতেন। তিনি নতুন কবিতার ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। যে কবিতা নেতিয়ে পড়া লিরিক্যাল নয়, ছিল বক্তব্যপ্রবণ। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারাকে আত্মস্থ করেই তিনি কাব্য রচনায় নতুন ধারা যুক্ত করেছিলেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের দেশের সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনসংগ্রাম। কোন বাহুল্য ছিল না তাঁর কবিতা। লিখেছেন নিরেট ও মেদহীন কবিতা। শনিবার দুপুর ২টা ১৩ মিনিটের চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে থেমে রফিক আজাদের জীবন পরিভ্রমণ। আজ মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমি ও জাতীয় কবিতা পরিষদের যৌথ উদ্যোগে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে কবি রফিক আজাদ স্মরণে নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে।
×