ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৫ মার্চ ২০১৬

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৫ মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাদা রংয়ের গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৬ মার্চ শুরু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকেই বঙ্গবন্ধু পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কড়া নিরাপত্তার মধ্যে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে সামরিক গবর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাকে স্বাগত জানান। কোন সাংবাদিক ও বাঙালীকে এ সময় বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এদিকে, একেক দিন একেক কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এদিন তিনি বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। সমঝোতার নাটক করতে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে এলেও মুক্তিকামী বাঙালী তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। দেশবাসীকে তাদের অধিকারবঞ্চিত করার প্রতিবাদস্বরূপ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের খেতাব বর্জন অব্যাহত রাখেন। চারদিকে শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন। হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন এটিই ছিল একমাত্র পদত্যাগ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ খেতাব বর্জন ও পদত্যাগের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সব শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জনের আহ্বান জানায়। দেশবাসী আরও বেশি উৎসাহ ও উদ্দীপনা পেয়ে নিজেদের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। এ দিনে ঢাকা শহরে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সবার সভা-সমাবেশ চলতেই থাকে। একাত্তরের এ দিনে অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদ এ দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। তাঁদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মজিদ। বক্তব্য রাখেনÑ সৈয়দ হাসান ইমাম, ফরিদ আলী, শওকত আকবর, আলতাফ হোসেন, রওশন জামিল, আলেয়া ফেরদৌস প্রমুখ। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলো’ তে লিখেছেন, ‘... সিঁড়ির মুখ থেকে জামী চেঁচিয়ে ডাকল, মা, ভাইয়া, শীঘ্রই এসো, খবর শুরু হয়ে গেছে। টিভিতে শেখ মুজিবকে দেখাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে নিচে ছুটলাম। খবর খানিকটা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের গাড়িতে পতপত করে উড়ছে কালো পতাকা। দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। প্রতিবাদের কালো পতাকা উঁচিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছেন শেখ মুজিব। এর আগে কোনদিনও পাকিস্তান সরকার বাঙালীর প্রতিবাদের এই কালো পতাকা স্বীকার করে নেয়নি। এবার সেটাও সম্ভব হয়েছে।’ জাহানারা ইমাম সেই সময়কার বিবরণ দিতে গিয়ে আরও লিখেছেন, ‘...সারা দেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকায়, রাজশাহীতে, চট্টগ্রামে- সবখানে এই দাবি তুলে শান্তিপ্রিয় বাঙালীরা আজ মরিয়া হয়ে ওঠে, লাঠি-সড়কি যা পাচ্ছে তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাক হানাদারদের গুলির সামনে। ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা, পটকা, মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর।’ ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় আসেন তখন নয়া সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে বায়তুল মোকাররমে চলছিল স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিশাল জনসমাবেশ। নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সমাবেশ থেকে তখনকার শীর্ষ ছাত্র নেতারা সমস্বরে ঘোষণা দেন- বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাঙালীর ওপর সামরিক বিধি জারি করার ক্ষমতা কারও নেই। জনসভা থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিকেলে কবি সুফিয়া কামালের সভানেত্রীত্বে তোপখানা রোডে অনুষ্ঠিত হয় নারী সমাবেশ। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীরা দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। একাত্তরের এ দিন পেশোয়ার আইনজীবী সমিতির সভায় আসগর খান বলেন, বর্তমান মুহূর্তে শেখ মুজিব দেশের দুই অংশকে একত্রে ধরে রেখেছেন। সংখ্যাগুরু দলের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক এবং এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রসম্মত। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান ওয়ালী খান সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের আর কোন অস্তিত্ব নেই। পহেলা জুলাই থেকে এখানে চারটি পৃথক প্রদেশ হয়েছে। একই দিন ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরেও সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং চলতে থাকে। এ দিনে নেত্রকোনায় সুইপার ও ঝাড়ুদাররা ঝাড়ু, দা, লাঠি ও কোদাল নিয়ে মিছিল বের করে। বগুড়া, খুলনা, রংপুর, লাকসাম, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার সপক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়।
×