ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এবারের বাস্তবায়ন হার গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

ছোট হচ্ছে এডিপি ॥ কাটা পড়ছে ধীরগতির প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৫ মার্চ ২০১৬

ছোট হচ্ছে এডিপি ॥ কাটা পড়ছে ধীরগতির প্রকল্প

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ ছোট হচ্ছে চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)। অর্থ ব্যয় করতে না পারায় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা ছেটে ফেলা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে। ফলে সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার দাঁড়াচ্ছে ৯০ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকায়। কেননা মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৯৯৭ কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই আরএডিপির খসড়া তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে পরিকল্পনা কমিশন। অল্প সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও বাড়ানো যায়নি বাস্তবায়ন। বরং অন্য অর্থবছরের তুলনায় বাস্তবায়ন হার আরও কমেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু হয় এডিপির। চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বাস্তবায়ন শুরুর ছয় মাসের মাথায়ই এই উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে বড় দশটি মন্ত্রণালয় মূল বরাদ্দের চেয়ে আরও বেশি বরাদ্দ চেয়েছে বলে পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছ। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা সচিব তারিক-উল ইসলাম সংশোধিত এডিপি বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যেই দশ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপি তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোন কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদার প্রেক্ষিতে কাটছাঁটকৃত অর্থের পরিমাণ এর কম বা বেশি হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই আরএডিপি তৈরির বিষয়ে অনেকদূর কাজ এগিয়েছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি পরিকল্পনামন্ত্রী বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেও তার সঙ্গে বৈঠক করে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। তারপরই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকের তারিখ চাওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা সচিব জানান, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় আমার কাছে অতিরিক্ত ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি সম্পদ ও স্থনীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ মোট দশটি বড় মন্ত্রণালয় এডিপিতে তাদের মূল বরাদ্দের চেয়ে সংশোধিত এডিপিতে বেশি বরাদ্দ চেয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের (২০১৫-১৬) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক অংশের বরাদ্দ কমছে প্রায় পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মূল এডিপিতে যা বরাদ্দ ছিল (বৈদেশিক সহায়তার) ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে আরএডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আরএডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ছেঁটে ফেলার পরিমাণ ছিল মোট ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে সরকারী তহবিল থেকে ৩ হাজার ৬০০ কোটি কমিয়ে করা হচ্ছে ৫৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। মূল এডিপিতে সরকারী অংশে বরাদ্দ ছিল ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মূল এডিপির বাস্তবায়নে করুণ চিত্র ॥ চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৮ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ৪৪ শতাংশ। এবারের এডিপি বাস্তবায়নের হার গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৩৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিলের ২২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। আর বিদেশী সহায়তা থেকে ব্যয় হয়েছে দশ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো নিজেদের তহবিল থেকে ব্যয় করেছে এক হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকারের তহবিল থেকে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে আট মাসে ব্যয় হয়েছে ৩৭ শতাংশ অর্থ। ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিদেশী সহায়তা বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে ৩০ শতাংশ। সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের ৩৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এর আগে বলেছেন, অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রচুর বৃষ্টি ছিল। ফলে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। ধীর গতির প্রকল্পে বরাদ্দ কাট ছাঁট ॥ ধীর গতির প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দ কাটা হচ্ছে। সেই টাকা দেয়া হচ্ছে যেসব প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি দ্রুত সেগুলোতে। পাশাপাশি সম্পদের সীমাবদ্ধতার জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে চলমান প্রকল্প সমাপ্তির উপর বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। এডিপি সংশোধনের শুরুতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে। সম্প্রতি জারিকৃত আরএডিপির নীতিমালায় প্রকল্পভিত্তিক অর্থবরাদ্দের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প, কৃষি-কৃষিভিত্তিক শিল্প-বিদ্যুত উৎপাদন এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি সংক্রান্ত প্রকল্প, সরকারী- বেসরকারী অংশিদারিত্বের (পিপিপি) প্রকল্প এবং বৈদেশিক সহায্যপুষ্ট প্রকল্প। চলতি প্রকল্পের মূল এডিপি বরাদ্দ সংশোধনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো, চলতি অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পে বরাদ্দ নিশ্চিত করা, বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে উন্নয়নসহযোগী দেশ বা সংস্থার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদের দিকে নজর রেখে বরাদ্দ দেয়া, প্রকল্প সাহায্য ও জেডিসিএফ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দেয়া বরাদ্দ চূড়ান্ত বলে গণ্য করা এবং সিডিভ্যাট বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ রাখা। অনুমোদিত নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এডিপিতে বরাদ্দহীনভাবে (সবুজ পাতায়) অন্তর্ভুক্ত কোন বিনিয়োগ বা কারিগরি সহায়তা প্রকল্প অনুমোদিত হলে সেসব প্রকল্প সংশোধিত এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং কোন বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট নতুন অনুমোদিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রকল্প সাহায্য বরাদ্দ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সরকারী তহবিলের ম্যাচিং ফান্ড বরাদ্দের প্রস্তাব করা। সংশোধিত এডিপিতে নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উন্নয়ন ফলাফল কাঠামোতে চিহ্নিত ক্ষেত্রের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে অগ্রাধিকার প্রদান করে সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্প আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু হয় ডিসেম্বরে ॥ শুরু থেকেই এডিপি বাস্তবায়নের হতাশাজনক চিত্র বিরাজ করায় গত বছরেই শুরু করা হয় কাটছাঁটের প্রক্রিয়া। বৈদেশিক সহায়তা অংশের বিষয়ে ৩০-৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি-২ সম্মেলন কক্ষে দু’দিনের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর যেসব খাতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো হচ্ছে, কৃষি খাত, পল্লী উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান খাত, পানিসম্পদ খাত, শিল্প খাত, তৈল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাত, পরিবহন, যোগাযোগ, ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাত, শিক্ষা ও ধর্ম এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতি। ৩১ ডিসেম্বর যেসব খাত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করা হয় সেগুলো হচ্ছে, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাত, গণ সংযোগ, সমাজ কল্যাণ মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন, জনপ্রশাসন,বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাত।
×