ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাচারকারীদের মধ্যে অধিকাংশই ব্যবসায়ী

মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে ১৩ ব্যক্তি পাচার করেছে শত কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৫ মার্চ ২০১৬

মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে ১৩ ব্যক্তি পাচার করেছে শত কোটি টাকা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় আবাস গড়তে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বিনিয়োগ করেছেন এমন ১৩ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর ওই ১৩ ব্যক্তি অবৈধ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শত কোটি টাকার বেশি মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। মালয়েশিয়ায় মাই সেকেন্ড হোম নামে একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার সম্পদশালী ব্যক্তিরা বেআইনীভাবে ওই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ ও অর্থ পাচারের শামিল। আর এই প্রক্রিয়ায় পাচার হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে ওই সব ব্যক্তির নামে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া পর দুদক মালয়েশিয়া সরকারের কাছে একাধিক মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠায়। ইতোমধ্যে বেশকিছু এমএলআরের উত্তর মিলেছে। তবে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি না থাকায় সব তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ১৩ হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র ধরেই দুদকের অনুসন্ধানেও মিলেছে এর সত্যতা। ১৩ ব্যক্তির মধ্যে অধিকাংশই ব্যবসায়ী। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই নেতার নাম রয়েছে। যদিও তাদের মূল পেশা ব্যবসা। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়েছেন। সাধারণত মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস গড়তে ওই প্রকল্পের আওতায় এন্ট্রি ফি হিসেবে দুই লাখ রিঙ্গিত বা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩৮ লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এন্ট্রি ফিসহ ওই ১৩ জন এখন পর্যন্ত শত কোটি টাকা ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় জমা দেন। তবে অনুসন্ধানের স্বার্থে এখনই তাদের কারও নাম প্রকাশ করছে না দুদক। সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের নামে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগের বিষয়ে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অভিযোগ অনুসন্ধানে এর মধ্যে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের তালিকা থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষর না হওয়ার কারণে অনুসন্ধান কাজ কিছুটা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য সেকেন্ড হোম প্রকল্পে নতুন করে আবেদন করেছিলেন ৬৪৮ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮৭ জন, বিএনপি-জামায়াতের ৯৬ জন এবং বাকি ২৬৫ জন সুবিধাভোগী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলা। আর পাঁচ বছরে অন্তত ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়। আর এই নেপথ্যের মূল কারণ হলো কালো টাকা বিদেশে পাচার করা। আর এদের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে মালয়েশিয়া। এরপরই রয়েছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। এ দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে ‘বিনিয়োগকারী’, ‘উদ্যোক্তা’ ও ‘স্ব-কর্মসংস্থান’ কোটায় সহজেই ভিসা দিচ্ছে। দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, অর্থ পাচারের সবচেয়ে প্রচলিত পন্থা হলো মানি চেঞ্জার। ঢাকায় টাকা ডলারে রূপান্তরিত করার পর একই মানি চেঞ্জারের একটি নির্দিষ্ট শাখা থেকে ডলারের পরিবর্তে ওই দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়। কোন আইনী পদ্ধতিতে এ ধরনের লেনদেনের সুযোগ নেই। যা হচ্ছে সব বেআইনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআইয়ের প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১ হাজার ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ১ লাখ ২৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে। বিশ্বের যে ১৫০টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৪৭তম। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষ টিম অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করছে। দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতির বিষয়ে অনুসন্ধান কাজের তদারককারী কর্মকর্তারা বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি এখনও স্বাক্ষরিত হয়নি। ওই চুক্তি ব্যতীত মালয়েশিয়া সরকার কোন তথ্য দেবে না। তাছাড়া মালয়েশিয়ার দেয়া নথিপত্র ছাড়া আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারব না। আমরা ওই চুক্তির অপেক্ষায় রয়েছি।
×