ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

২০২১ সালের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৫ মার্চ ২০১৬

২০২১ সালের বাংলাদেশ

(১৪ মার্চের পর) যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ল অব ল্যান্ড অনুসারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্পূর্ণ সুযোগ দিয়ে প্রকাশ্যে বিচার কাজ চলছে। বেশ কয়েকজন পালের গোদার মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালে। এতে জনমনে স্বস্তি আসে। আইন মান্যকারী দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে একটা পর্যায়ে বর্তমানের চলমান ২০/২২টি মামলা সম্পন্ন করার পর নতুন কোন মামলা শুরু না করাই ভাল হবে বলে মনে হয়। ঢাকার দুই মেয়রের দৃঢ়হস্ত জবরদখল উচ্ছেদের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আদালতের কয়েকটি রায়ের দ্রুতগতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। দ্রুততম গতিতে সিলেট ও খুলনায় শিশু হত্যার বিচার হয়েছে। এর বাস্তবায়ন জরুরী। সম্প্রতি উচ্চতর ন্যায়ালয়ের আপীল বিভাগ স্বঘোষিত ‘দানবীর’ রাগিব আলীর চাঞ্চল্যকর চা শিল্পের জন্য বরাদ্দ ভূমিকে বেআইনীভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করে গৃহনির্মাণের বেআইনী ও অনৈতিক কর্মকা- এবং সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দখল করে মধুবন বাজার স্থাপনের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে যে যথার্থ রায় ঘোষণা করেছে এর আশু বাস্তবায়ন জরুরী। এতে ভূমিখেকো এবং জলাধার দখলকারীদের আইনের শাসনে এনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা জোরদার হবে। দেশের শতকরা ৭৩ ভাগ লোক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে আস্থাশীল। এই ধারা বজায় রাখতে হবে। একটি দক্ষ, চৌকস, স্বচ্ছ, সৎ ও ন্যায়ের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম সরকারী কর্মকর্তা-কর্মাচারী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাহসী সরকার অষ্টম বেতন কাঠামোতে শ্রেণী বৈষম্য দূর করে বেতন প্রায় দ্বিগুণ করেছে এবং অন্যান্য যুক্তিগ্রাহ্যের ও অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে। দেখা দিয়েছে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। ক্যাডার-নন ক্যাডার ইস্যু ও শিক্ষকম-লীর যে সকল দাবি ন্যায়সঙ্গত, যেমন অধ্যাপকবৃন্দকে দ্বিতীয় গ্রেডে/স্কেলে (সপ্তম বেতন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেড/স্কেলে ছিলেন) অবস্থান দিয়ে পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রথম গ্রেডে যাবার ব্যবস্থা করে এই অভূতপূর্ব উদ্যোগের সুফল পূর্ণভাবে ঘরে তোলা সম্ভব ও উচিত হবে। ক্যাডার-নন ক্যাডার ইস্যুটি অহেতুক সৃষ্টি করা হয়েছে; এটি খুব সহজেই সমাধান করা যায়। কল্যাণ রাষ্ট্রে গণকর্মচারী ও স্বায়ত্তশাসিত এবং আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মিলে প্রায় ২৪ লাখ লোক কর্মরত। অর্থাৎ এক কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বেতন-ভাতা ছাড়াও সরকারী প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্য ও জীবন বীমা, ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হওয়া, প্রস্তাবিত সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংকে শেয়ার মালিক হওয়া, অধিকতর পেনশন সুবিধা, বৈশাখী ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে শেখ হাসিনা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ২০২১ সালের প্রত্যাশা ২০১৬ সালের তিনশত ছেষট্টি দিনের প্রথম দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যার্থীদের হাসিমুখ বিজয় উৎসবে ৩৩ কোটি বই বিনামূল্যে পৌঁছে গেছে। ২০১৬ সালে আরও উন্নতি ঘটুক ঈর্ষণীয় বিদ্যুত উৎপাদনের অগ্রগতিতে। ২০২৫ সালের পর পরিবেশবাদীদের চাপে সম্ভবত কয়লাবিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। তাই বাংলাদেশের উন্নত জাতের বিটুমিন জাতীয় কয়লাকে ওপেন পিটের শতকরা ৯০ ভাগ উৎপাদনশীল আহরণে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় একটি সমন্বিত পথপরিক্রমায় স্বচ্ছ নীতি কৌশল ও ন্যায়সঙ্গত প্রণোদনা দিয়ে অবিলম্বেই শুরু করতে হবে। রামপালের ১২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্লান্টের বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া যেতে পারে যে, অত্যন্ত দক্ষ প্রযুক্তি ও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কয়লাবিদ্যুত উৎপাদন করা হবে। তাছাড়া বাপেক্সের মাধ্যমে গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নে ব্যাপক ও আশু মনোযোগ এবং বিনিয়োগ অচিরেই সুফল দিতে পারে। তবে গ্যাসের ব্যবহারে বিদ্যুত উৎপাদন খুবই অলাভজনক; এর বদলে গ্যাস দিয়ে শিল্পায়নে যেতে হবে। বন্ধু প্রতিবেশী ভারত, নেপালের উপআঞ্চলিক সহযোগিতায় বৃহৎ পরিসরে জলবিদ্যুত উৎপাদনে যাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নামতে হবে। সম্পন্ন করা যেতে পারে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান সংবলিত রূপপুর আণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত আহরণ ২০১৯ সালের মধ্যেই। ২০২৫ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুত, বায়োগ্যাস বিদ্যুত ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে শতকরা ১০ ভাগ বিদ্যুত আহরণসহ মোট ২৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র্য নিরসনের উপায় হিসেবে ব্যাপক শিল্পায়ন প্রচেষ্টা সফল হবে। উল্লেখ্য, বস্ত্রশিল্পে বিপুল প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে উন্নতমানের আধুনিক প্লান্টে সুতা কাটা ও কাপড় বুননে গতি আসে। পর্যাপ্ত গ্যাস ও ২২০ ভোল্টেজ বিদ্যুতের উচিত মূল্যে অর্থাৎ বর্তমান দরের দ্বিগুণ মূল্যে দিতে পারলেও এ খাত ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিপ্লব আনতে পারবে। কাঁচা তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ- ভাল লক্ষণ বৈকি! তবে সরকারীভাবে সেন্ট্রাল এ্যাপলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করে বড় বড় বস্ত্রমিলকে ভাড়ায় সার্ভিস দিতে হতে পারে। শিল্পায়নে ওষুধ, চামড়া, খেলাধুলার সরঞ্জাম, হালকা যন্ত্রপাতি, রাবার, জাহাজ নির্মাণ, মোটরসাইকেল, ফলভিত্তিক খাদ্য, আলু প্রক্রিয়াজাতকারী খাদ্যপণ্য, বাইসাইকেল, আসবাবপত্র, ইলেক্ট্রনিক্স, হ্যান্ডিক্রাফ্টস, প্রসাধনী ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। স্মর্তব্য যে, সম্প্রতি বাংলাদেশ পুরনো জাহাজ আমদানিতে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পরিবেশ সুরক্ষা সচেতনতাসহকারে অগ্রসর হলে জাহাজ ভাঙা শিল্পে সম্প্রসারণ ঘটিয়ে স্থানীয় মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাটের থলে ব্যবহারে খুবই কড়াকড়ি করতে হবে; সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে পলিথিন ব্যাগ। উৎপাদন ও রফতানিতে বহুমাত্রিকতা আনা হোক ২০১৬ সাল থেকেই। রেলের ব্রডগেজিকরণ, ডাবল ট্রেকিং ও বিদ্যুতায়নও শুরু হোক নতুন বছরেই। উচ্চশিক্ষা কমিশন, শিক্ষা আইন ও এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল স্থাপন হোক ২০১৬ সালে, যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে। জনমিতিক লভ্যাংশ সুবিধা পেতে হলে মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করতে হবে। আর উচ্চশিক্ষা হবে প্রযুক্তিপ্রধান। আইসিটিতে বিপুল সাফল্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে উল্লম্ফন এনেছে। জাতির পিতার প্রদর্শিত পথে ‘সবার সঙ্গে সখ্য, কারও প্রতি বৈরী নয়’ নীতি অনুসরণ করে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় সম্মানের আসনে রয়েছে। চলবে... লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
×