ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৫ মার্চ ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

আরেকটি ফাগুন বিদায় নিল। রাজধানী ঢাকায় ফাগুন ত্রিশ দিনের জন্য কি আসে? প্রকৃতপ্রস্তাবে ৩০ দিনে মাস হলেও ফাগুন আসে স্বল্প সময়ের জন্যেই অনেকটা ‘মাধবী এসেই বলে, যাই’-এর মতোই। কোন জানালা দিয়ে এসে কোন দরজা গলিয়ে পালিয়ে যায়, তার কোন হদিসই মেলে না। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ফাগুন নির্বাসিত হচ্ছে নগর থেকে। নগর নয়., গ্রামেই পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করা যায় বর্ষা। মনে হচ্ছে ফাগুনের বেলায় এ কথার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। নগরে নয়, গ্রামে আছে বসন্ত! ফাগুন চলে যাচ্ছে বলে বসন্তবিলাসীরা যতই আক্ষেপ করুক না কেন, এই মহানগরীতে ফাগুন এবার দরাজ গলায় নয়, গান গেয়েছে গুনগুন সুরে। ফাগুন নিয়ে আর একটিও বাক্য নয়, তাহলে আদিখ্যেতার মতো শোনাতে পারে। বরং গায়ের পরে এসে পড়া চৈত্রের কথা বলা যাক। ঢাকা ইতোমধ্যে চৈত্রের ‘নির্মমতা’ দেখাতে শুরু করেছে। এরই ভেতর তাপমাত্রা পৌঁছে গেছে প্রায় পঁয়ত্রিশের কোঠায়। এর চেয়ে দু’ডিগ্রী চড়া দক্ষিণের জেলা যশোরে। ভাবছি এবার বৈশাখে কী দশা হবে রাজধানীর। এইসব অপমৃত্যু অপঘাতে মৃত্যুর নানা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নগর যা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। গত বর্ষার সময় নালার পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু হয়েছিল। গ্রামে পুকুরে ডুবে মৃত্যু তেমন আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। কিন্তু শহরে নালায় ডুবে মৃত্যু উদ্ভট ও করুণই শোনায়। পথে চলতে চলতে মাথার ওপর ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে মৃত্যুর ঘটনার কথা লিখেছিলাম একবার এই কলামে। এখন যে সকরুণ মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলছি তা একেবারে অভিনব, দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই। ভবন নির্মাণের সময় ওপর থেকে পড়ে শ্রমিকের মারা যাওয়ার কথা আমরা জানি। এমনকি উঁচু থেকে নির্মাণ সামগ্রী মাথায় পড়ে আহত হওয়ার বিষয়টিও না হয় কান-সহা হয়ে গেছে। কিন্তু নগরীর অভিজাত এলাকা ধানম-ির সড়কে চলমান রিক্সার ওপর আস্ত গাছ নুয়ে পড়ে মানুষের মৃত্যু! এ এক অসম্ভব বা এ্যাবসার্ড ব্যাপার বলেই মনে হয়। অথচ এমন ঘটনাই ঘটেছে গত সপ্তাহে। তার আগের দিন রাতে বেশ ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। পরদিন শহর ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। এমন একটি রোদেলা দুপুরে বিরাট গাছ পতিত হয়েছে খ্যাতিমান ব্যক্তির ওপর! চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, চিত্রপরিচালক- অনেক পরিচয় খালিদ মাহমুদ মিঠুর। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন আরেক চিত্রশিল্পী কনক চাঁপা চাকমাকে। না, এখানে মিঠুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন বিবরণ দেব না। শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করব এমন উদ্ভট অনাবশ্যক ঘটনা রোধ না করতে পারা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। সড়ক পাশের মরণাপন্ন গাছগুলো অপসারণের দায়িত্ব পালন করলে আমরা এই অকালমৃত্যু হয়ত এড়াতে পারতাম। একটি নগর গড়ে ওঠে কিছু নীতি, রীতি ও পরিকল্পনাকে কেন্দ্র রেখে। সেই নগর রক্ষণাবেক্ষণেও ব্রতী হতে হয় কর্তৃপক্ষকে। নগরের বহু স্থানেই চুরি করে কিংবা নামমাত্র অজুহাতে বৃক্ষনিধন উৎসব চলে। জলজ্যান্ত গাছগুলোকে হত্যা করা হয় শুধু অর্থলোভ থেকে। অথচ যেসব গাছ ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে, যেমন ধানম-ির ওই কৃষ্ণচূড়া, ভূমিশয্যা গ্রহণের আগে তার শুশ্রƒষা কিংবা অপসারণের কোন পরিকল্পনাই নেই সিটি কর্পোরেশনের। গাছ আমাদের প্রাণ রক্ষাকারী। তাকে প্রাণ হন্তারকের ভূমিকায় বাধ্য করার জন্য আমরা কোন আদালতে বিচার চাইব? ধসে পড়েছে রাস্তাও নুয়ে পড়া গাছের ধরনেই যেন, ধসে পড়েছে রাজধানীর আরেক অভিজাত অঞ্চল গুলশানের একটি রাস্তাও। গুলশান লেকপাড়ে রাস্তা ধসে পড়ার বিষয়টি এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ‘গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প’-এর কাজের অংশ হিসেবে ৫৫ নম্বর সড়ক-সংলগ্ন লেকের পানি সেচ করা হয়েছে। বিশেষ করে লেকের বর্জ্য অপসারণের জন্য সেখানে পানি সেচ করা হয়। সড়কের শুরুর অংশ থেকে অপর পাড়ে বনানী প্রান্ত পর্যন্ত মাস দু-এক আগে বালুর বাঁধও দেয়া হয়। পানি সেচ করে এবং লেকের বর্জ্য তুলে বাঁধের অপর পাড়ে ফেলা হয়। এতে ওই অংশটি সম্পূর্ণ পানিশূন্য হয়ে পড়ে, বেড়ে যায় লেকের গভীরতা। ধসে পড়া রাস্তার কাছে লেকে সপ্তাহ তিনেক আগে মাটি খুঁড়ে বড় আকারের কিছু পাইপ বসানো হয়। সপ্তাহখানেক আগে রাস্তায় কিছু ফাটল দেখা যায়। ২৯ নম্বর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সাংবাদিকদের জানান, ওই সময় রাজউকের লোকদের বিষয়টি জানালে তারা গুরুত্ব দেননি। যাহোক, উন্নয়ন কর্মকা- করতে গেলে সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কাটিকেও আমলে নেয়া কর্তব্য। রাস্তা ধসে পড়ার ফলে অবশ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, সেটাই স্বস্তি। আগামীতে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আরও সতর্কতা আশা করি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঢাকার মেয়ররা একটি সেমিনারে বলেছিলেন মহানগরীর পরিচ্ছন্নতার দিকটিই তাদের কাছে সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাচ্ছে। জানতে পারলাম নগরীর ৬০০ খোলা কন্টেনার থেকে প্রতিদিন ৫,০০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। আমরা এই কলামে দফায় দফায় রাজপথের দুরবস্থার কথা লিখে আসছি। বিশেষত রাস্তার মাঝখানে রাখা আবর্জনা ফেলার কন্টেনার এবং রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পচা উচ্ছিষ্টের দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গ নিয়ে বার বার লেখা হয়েছে। সেদিন দেখলাম শাহবাগে ফুলের দোকানগুলোর কাছাকাছি ফুটপাথের নালায় পচা গাঁদা ফুলের জঞ্জাল, দুটো ভ্যান লাগবে সরাতে এই পরিমাণ আবর্জনা। আমরা আগেও বলেছি ঢাকার সড়কগুলোর পাশে যেসব দোকানপাট গড়ে উঠেছে সেসব দোকানের দোকানিদের তাদের সামনের রাস্তাকে ডাস্টবিন জ্ঞান করার এক অদ্ভুত মানসিকতা রয়েছে। রাস্তার পাশে নয়, একেবারে মাঝখানে সিটি কর্পোরেশনের মুখ খোলা কন্টেনার রাখার কথা আবারও বলতে হচ্ছে। রাজধানীর রাজপথের পাঁজরে দুষ্ট ক্ষতের মতো জেগে থাকা একেকটা ভাগাড় পথচারীদের বিপর্যস্ত করে চলেছে। মিউনিসিপ্যালিটির খোলা কন্টেনার থেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া বর্জ্যরে কুশ্রিতা আর তা থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অস্বাস্থ্যকর উৎকট গন্ধে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা- এ তো আর বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে না একটা মহানগরীতে। অবাক মানতে হয় কর্তৃপক্ষের কা-জ্ঞান দেখে! নিউ ইস্কাটনে রাস্তার মাঝখানে খোলা ডাস্টবিন বা ভাগাড়খানার কথা একবার বলেছি। অবাক ব্যাপার হচ্ছে এখানে নতুন আরেকটি ভাগাড়খানা গজিয়ে উঠেছে। এটি আগেরটার চেয়েও বিশাল। ঠিক যেখানটায় উড়াল সড়কটির সূচনা সে জায়গাটিকেই বেছে নেয়া হয়েছে উন্মুক্ত স্বাধীন ময়লা ফেলার (নাকি ছড়াবার?) স্থান হিসেবে। এটা কার মাথা থেকে এলো জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্যই ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। নগরবাসীর আবর্জনা ফেলা এবং কর্তৃপক্ষের তা অপসারণ- সব কিছুই হতে হবে নিয়মমাফিক। ভাবি এর প্রতিকারে জনস্বার্থে আমরা একটা রিট কেন পাই না! কবির মৃত্যু! কবির মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়। একথা লেখার পরে বাস্তবের কাঠিন্যে পা রেখে বলতেই হয়, কবির শারীরিক প্রস্থান আছে। সেই প্রস্থান আমাদের কাঁদায়, আবেগে ভাসায়। আমরা যে কবিকে ভালবাসি। কবিতার প্রতি রয়েছে আমাদের এক ধরনের অন্ধ পক্ষপাত। কবি রফিক আজাদ ষাটের শক্তিমান কবি, ছন্দে ছিলেন দক্ষ। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফাল্গুন মাসে। আর তাঁর প্রস্থানও হলো ফাল্গুনেই। এবারের ফাল্গুনের রং ও রোদন- সব বুঝি তাঁরই জন্য। প্রেমের ঋতুতে জন্মগ্রহণ করলেই কেউ প্রেমিক হবেনÑ এমন কোন কথা নেই। অথচ আমাদের কবিটি ছিলেন মহাপ্রেমিক। তিনি বিলক্ষণ জানতেন, প্রেম মানে পাগলামি। সেই পাগলামিও কি তিনি কম করেছেন? দুঃখের কথা হলো জীবনের শেষ কয়েকটি সপ্তাহ তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। কোমায় গেলেও কবির অন্তরের সৃষ্টিশীলতায় কোন কমা বা যতিচিহ্ণ পড়ে না- এমনটা ভাবতেই আমাদের ভাল লাগে। কবিকুলে তিনি ছিলেন অন্যতম সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। আর জীবনযাপনে মুক্ত, পরোয়াহীন এবং স্টাইলিশ। তাঁর পানপ্রীতি নিয়ে কত গল্পই না ডালপালা মেলেছে। সে যাই হোক, কবির আরেকটু উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা কি আমরা করতে পারতাম না? অন্তত তাতে একটা সান্ত¡না পাওয়া যেত। এখন কেবলই আফসোস আর হাহাকার। আমাদের লেখকসমাজের মনমানসিকতা তীব্র ভাষায় তুলে ধরেছেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। সেখান থেকে খানিকটা পাঠ করা যাক। তিনি লিখেছেন: ‘ মা কবি দিলারা হাফিজকে পাশে নিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে শোকপ্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে কবি রফিক আজাদের ছোট ছেলে অব্যয়। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কবিকে মৃত ঘোষণা করার এক ঘণ্টা পরের দৃশ্য। গত দুই মাসে অসুস্থ কবির পাশে যাদের ছায়াও দেখা যায়নি, এই সময় কবির শোকসন্তপ্ত স্বজনদের গায়ে আঠার মতো লেপ্টে ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেই অতিপরিচিত গোরখোদকেরা। নিত্যদৃশ্য। কবি রফিক আজাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন না-হওয়া পর্যন্ত গোরখোদকরাই এখন মরদেহের হর্তাকর্তা।... আজ কবির মরদেহ যাবে হিমাগারে। পরশু সোমবার প্রবাসী বড় ছেলে অভিন্ন এলে কবির দাফন। তার আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কফিনে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদন। এখন থেকে তখন পর্যন্ত সময় গোরখোদকদের। তারা শোক, কবি ও কবিতার চেয়ে মরদেহ বোঝেন বেশি। আরও বোঝেন, কফিন আঁকড়ে ধরে মিডিয়ার ক্যামেরায় দুয়েক ছটাক প্রচার কুড়ানো।’ ঢাকায় শ্রীকান্তের গান ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির নন্দনমঞ্চ সত্যিই এক মনোহর স্থান। তিন পাশে গ্যালারি, কেন্দ্রে চৌকোনা মঞ্চ। মঞ্চের চারপাশে ঝরনা। যে দিকটায় (দক্ষিণ) গ্যালারি নেই, সেদিকেই পিঠ দিয়ে বসেন শিল্পীরা। বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংসদের আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শ্রীকান্ত আচার্যসহ ক’জন শিল্পী এসেছিলেন। দুদিনব্যাপাী উৎসবের একটি মর্মবাণীও ছিলÑ শুভ কর্মপথে, ধর নির্ভয় গান। শ্রীকান্ত আচার্য বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। আয়োজকরা সেটা জানেন বলেই সবশেষে তাঁর গান রাখলেন। সন্ধে সাড়ে ছ’টায় শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে মঞ্চে যখন এলেন শ্রীকান্ত, তখন ন’টা বেজে গেছে। যাঁরা পণ করে এসেছিলেন শ্রীকান্তের গান শুনবেনই শুনবেন, তাঁরাই ছিলেন। তবে একটু আশাভঙ্গ হলো শ্রোতাদের। শ্রীকান্ত মাত্র পাঁচখানা গান শোনালেন। একটা কথা না বললেই নয়। সেদিন ফাল্গুন সন্ধ্যায় দখিনা বাতাস বইছিল। একাডেমির দক্ষিণ প্রাচীর লাগোয়া ফুটপাথের ওপর নোংরা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ফ্রিস্টাইলে। বাতাসে তার দুর্গন্ধ ভেসে এসেছে সারাক্ষণই দক্ষিণ-পূর্ব গ্যালারিতে। নাকে রুমাল চেপে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা! অভিনব অভিজ্ঞতা বটে। ১৩ মার্চ ২০১৬ [email protected]
×