ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রেম ও দ্রোহের কবি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৫ মার্চ ২০১৬

প্রেম ও দ্রোহের কবি

বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য কবি রফিক আজাদ আর নেই। ঢাকার বিএসএসএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ৫৮ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেন মৃত্যুর কাছে ৭৫ বছর বয়সে। দিনটি ছিল শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬, অপরাহ্ন ২টা ১০ মিনিট। ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষ করে কবিতাঙ্গনে দিনটি নিঃসন্দেহে শোকাচ্ছন্ন ও বেদনাবিধুর। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি তিনি। মূলত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের রবীন্দ্র-পরবর্তী ত্রিশোত্তর পঞ্চ কবির সুনিবিড় ছায়া-প্রচ্ছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা হলেও অচিরেই কবিতায় তিনি এক নিজস্ব বলয় ও স্বকীয়তা সৃষ্টি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় বিশেষ করে ফরাসী কবি বোদলেয়ারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব তাঁর কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা ও মর্যাদা। প্রথম জীবনে উড়নচ-ী স্বভাব, প্রচলিত প্রথা না মানার প্রবণতা, বোহেমিয়ান আচার-আচরণ সত্ত্বেও কবিতার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা তাঁকে গ্রাস করেছিল আদ্যোপান্ত। মূলত ছোট পত্রিকা ‘স্বাক্ষর’ সম্পাদনার মাধ্যমেই সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব, যা অচিরেই কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হলো কবিতার প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে। সাহিত্যপত্রিকাসহ জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সম্পাদনায় রেখেছেন দক্ষতার ছাপ। এর পাশাপাশি সংযুক্ত হলো সমকালীন বাস্তবতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও টানাপোড়েন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা-সঙ্কটের চাপ, ব্যক্তির সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা, সর্বোপরি বিরূপ প্রকৃতি ও পরিবেশ। ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ নিয়ে দুর্মর ও অকুতোভয় যে কবির যাত্রা শুরু, তা ক্রমে ক্রমে আরও বিকশিত ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ ‘পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’ প্রেমের কবিতা সমগ্র, ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’, ‘বিরিশিরি পর্ব’ ‘হৃদয়ের কী বা দোষ, ‘কোন খেদ নেই’, ‘প্রিয় শাড়িগুলো’ গ্রন্থনিচয়ে। শেষ জীবনে আত্মজীবনীও লিখতে শুরু করেছিলেন, যেটি অপূর্ব টান টান ‘নির্মেদ গদ্যে’ জীবনস্মৃতির নির্মোহ বিশ্লেষণ। রফিক আজাদ কেমন কবি ছিলেন অথবা বাংলাদেশের সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্য তাঁকে কোন্ পর্যায়ে রেখে বিচার করবে, তা তোলা থাক ভাবীকালের জন্য। আমরা বরং তাৎক্ষণিক বিচারে দেখতে পাই যে, কবি রফিক আজাদ ছিলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি; একইসঙ্গে স্বাধীনতা এবং গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্নেরও। দেয়ালের লিখন অথবা মানুষের মুখের ভাষাকে তিনি সহজেই রূপান্তরিত করতে পারতেন কবিতায়। ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ অথবা ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’ সর্বদাই নর-নারীর আকুল-ব্যাকুল ভালবাসা এবং সভ্যতার সঙ্কটে প্রতিনিয়ত অবক্ষয় ও ধ্বংসের সম্মুখীন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা বলে উচ্চকণ্ঠে। প্রেম ও দ্রোহ, বিপ্লব ও বিদ্রোহকে সততই মিলিয়েছেন কবিতায়, সম্ভবত নিজের জীবনেও। খুব কম কবির ভাগ্যেই এমন মেলবন্ধন ঘটে। রফিক আজাদ ছিলেন সেই বিরল প্রজদের একজন। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা এই অকুতোভয় কবিকে আমরা জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন এবং পরিবারের সদস্যদের জানাই গভীর সমবেদনা।
×