ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রামাণ্য দলিল

’৭১-এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৪ মার্চ ২০১৬

’৭১-এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস

গৌতম পাণ্ডে ॥ ’৭১-এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস’ বইটি কাল্পনিক নয়, আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তুলনামূলক চিত্রও নয়। এটি উচ্চতর মানবিক চেতনাকে উজ্জীবিত এবং শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এক গবেষণাধর্মী প্রামাণ্য দলিলও বটে। কেননা গ্রন্থটি বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কাডানাতে প্রাপ্ত প্রামাণিক দলিলাদির ভিত্তিতে রচিত। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসের যে অজানা দিক রয়েছে, সে দুর্জ্ঞেয় বিষয়ে গবেষণা করে যে নতুন তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, সে বিদিত অংশটুকু এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন অটোয়া প্রবাসী লেখক মুস্তফা চৌধুরী। এই গ্রন্থ পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালী নারীদের প্রতি নির্দয় ও বর্বরতার চিত্র উপস্থাপনসহ যুদ্ধশিশুদের জন্মকথা এবং তাদের জন্মপরবর্র্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে তৎকালীন বাংলাদেশ ও কানাডার প্রশাসনিক আইনী জটিলতা এবং উভয় দেশের শ্রেণী বৈষম্যবোধ, বর্ণবৈষম্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের খুঁটিনাটি বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। অধিকৃত বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জবর-দখল করে থাকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অগণিত নারীদের ধর্ষণ করে, ফলে যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে কিছু যুদ্ধশিশু কানাডার নানা প্রান্তে লালিত-পালিত হয়েছে। মোটকথা যে ১৫ যুদ্ধশিশুকে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে বসবাসের জন্য পাঠানো হয়েছিল, তারা পরবর্তী জীবনে কতটুকু সফল হয়েছে সে বিষয়টি উঠে এসেছে এ বইটিতে। সেই সব যুদ্ধশিশুদের বয়স এখন তেতাল্লিশ পেরিয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে তারা কিভাবে বড় হয়ে উঠেছে সেগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধশিশুদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে হলে এ গ্রন্থের প্রথম তিনটি অধ্যায় পাঠ করা পাঠকের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়গুলো, যেমনÑ বাংলাদেশ থেকে কানাডা যুদ্ধশিশুর দুঃসাহসিক অভিযান; দত্তকগ্রাহী বাবা-মার আনন্দ-বেদনা এবং কানাডাতে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশু আধুনিক পাঠকের মনে বিশ্বমানবিকতার কারণে এমন অনেক জিজ্ঞাসা জাগাতে সক্ষম হতে পারে। সেগুলো বর্তমান একুশ শতকের পরিস্থিতি তাড়িত বিপর্যস্ত মানুষের মনে নতুন অনুসন্ধিৎসা আশা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মানব কল্যাণের সর্বোকৃষ্ট মতবাদ গ্রহণের আগ্রহ জাগাবে। হাজার বছরের ঘুণে ধরা সমাজের বেড়া ভেঙ্গে আলোর পথে কোন বাংলাদেশী সেই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের কোলে তুলে নিতে না পারলেও কিছু কানাডীয় পরিবার সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে এগিয়ে এসে সেই অবহেলিত যুদ্ধশিশুদের কোলে তুলে নিয়েছিল। এই শিশুরা কানাডার বৃহত্তর পরিবেশে গড়ে তুলেছে তাদের জীবন। কিন্তু তারা জানে তাদের জন্মের ইতিহাস, জানে তাদের জন্মদাত্রী ধর্ষিত মায়েদের করুণ কাহিনী ও তাদের অভিশপ্ত জীবনের অলিখিত ইতিহাস। সর্বোপরি বিশ্ব মানবিকতাকে কেন উপেক্ষা করা যায় না দেশে দেশে, কালে কালে এবং সর্বকালে দত্তক সন্তানের মানসজগৎ কেমন হয়ে থাকে এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন ধরনের ভূমিকা অপরিহার্য, তারই অনুপুঙ্খ ও চমকপ্রদ বিশ্লেষণ করেছেন লেখক মুস্তফা চৌধুরী তার তথ্যবহুল গবেষণামূলক গ্রন্থ ’৭১ এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস-এ।
×