ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জগলুল কবির

প্রেরণায় স্বাধীনতার মাস

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৪ মার্চ ২০১৬

প্রেরণায় স্বাধীনতার মাস

আমাদের স্বাধীনতার মাস এ মার্চ । ১৯৭১ সালের এ মাসেই শুরু হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। আর ষড়ঋতুর হিসেবে বসন্তকাল। এখন চৈত্র মাস। না শীত না উষ্ণ, শরীর-হাত-পায়ে একটা শুষ্কভাব। লোশন-ক্রিম-তেল না লাগালে অস্বস্তি বোধ হয়। তবে প্রকৃতির এক নতুন অনুভূতি এসেছে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। বিশেষ করে আমগাছে নতুন পাতা আর আমের মুকুল এক নতুনত্ব এনেছে প্রকৃতির চারদিকে, যাতে করে আমাদের আশপাশ সবদিকে ভরে ওঠেছে নতুন জীবনে। শীতে যেসব গাছের পাতা ঝরে পরেছিল, রুগ্ন অবস্থায় নিজে ছিল, তা যেন বসন্তের আগমনে দখিনা হাওয়ার গন্ধকে উপলব্ধি করেছে, জেগে ওঠেছে নতুন করে। যাতে আছে নতুনের সৃষ্টি, নতুনের আবির্ভাব। গাছে গাছে ফুটেছে লাল-হলুদ-সাদা আর বাহারি কত রঙের ফুল। ফুলে ফুলে ফুলের গাছগুলো ডানা মেলেছে শহর-গ্রাম সব বসতিতেই। ঝরাপাতার সে গাছগুলো আবার কোমল হালকা সবুজ রূপে নতুন নতুন পাতায় নিজেকে ভরে দিয়েছে, ধারণ করেছে স্নিগ্ধ এক মায়াবি রূপ। গাছে গাছে নতুনের আবির্ভাব। শীতের নিষ্ঠুরতায় গাছের পাতা টিকে থাকতে না পারলেও, গাছটি টিকে ছিল, যা এ বসন্তে নতুনভাবে আবার জেগে ওঠে আমাদের মানবতার জন্য সাজিয়েছে এক অনাবিল নির্মলতায়। কি অনুভূতি এ প্রকৃতির। প্রকৃতির বৃক্ষগুলো যেন বোবা প্রাণী। ওরা সব সময়ই চায় এ পৃথিবীর সব মানুষ যেন সব সময় সুখে শান্তিতে অপরূপ প্রকৃতির সঙ্গে সুন্দর আনন্দে জীবনযাপন করে। এমন ঋতুতে দিনে বা জোসনারাতে যদি কেউ আমাদের মাতৃভূমির জেলায় জেলায় নদীর পারে পারে ঘুরে বেড়ান তাহলে মনে হবে সত্যি ‘আমার সোনার বাংলা তুমি অপরূপ রূপের রানী, এ দেশেতে জন্ম নিয়ে ধন্য হয়েছি আমি।’ ঝিরঝির দখিনা বাতাস যখন নদীকে স্পর্শ করে আমাদের দেহমনে ছুয়ে যায় সত্যি তা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি, স্বর্গীয় সুখ। তবে সেই পবিত্র ঝিরঝির বাতাসকে আমাদের অনুভূতিতে আনতে হবে। তা না হলে এমন নদীমাখা স্নিগ্ধ বাতাসে আমাদের হৃদয়ে কোন দাগ কাটবে না, আমাদের মনে এর কোন নতুনত্বের দোলা দেবে না। মনে হবে না এ অনাবিল সুখের দোলা । মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্যই কবিসাহিত্যিক-লেখকরা কবিতা, কাব্য, মহাকাব্য আর উপন্যাস লিখে চলেছেন। তেমনিভাবে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই আমাদের মহান, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক, সৎ, আদর্শবান নেতারা আমাদের সব মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য আবেগ তৈরি করেছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে দুই প্রান্তের দুই জাতির এক দেশ ছিল। যেখানে পাকিস্তানীরা আমাদের ধর্মের সঠিক মর্মবাণী অনুধাবন করতে না পেরে বরং ধর্মের নামে এক থাকতে চেয়েছিল। জুলুম, তাদের আধিপত্যবাদী মানসিকতা, আমাদের বাংলাদেশীদের অবমাননার চোখে দেখার মানসিকতায় মেতে ওঠেছিল। আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার উপলব্ধি থেকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। আমাদের বাংলাভাষা বাদ দিয়ে ওদের ভাষায় আমাদের অফিস-আদালত করার আধিপত্য চাপিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়, যা আমাদের দেশের স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা মানতে পারেনি। কারণ পরাধীনতার শৃঙ্খল স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমিক মানুষ কখনই মানতে পারে না। তাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ওদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবনকে বাজি রেখে রাস্তায় নেমে এসেছিল বাংলার তরুণ-যুবক দামাল সন্তানেরা। আর হানাদার নির্মম পাকিস্তানীবাহিনী সেই প্রতিবাদকে অস্ত্রের মুখে ঠেলে দিয়ে তরুণ প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার বুকের ওপরে গুলি চালায়। যাতে শহীদ হয় আমাদের দেশের সালাম-বরকত-জব্বার-রফিকসহ কত অমর প্রাণ। আমরা, আমাদের অগ্রজরা পাকিস্তানীদের জুলুম-আধিপত্যবাদীদের বিপরীতে জীবন দিয়েছে কিন্ত মাতৃভাষাকে হারাতে দেয়নি। এটাই হলো আমাদের স্বাধীন মানসিকতার বহির্প্রকাশ। ১৯৫২ সালের পরও পাকিস্তানীরা কখনই দুই প্রান্তের দুই ভূখ-ে সমতার ভিত্তিতে শাসন করার ব্যবস্থা করেনি। ওদের আধিপত্য, প্রভুত্ব চালিয়ে আমাদের অধিকারকে দাবিয়ে রাখতে থাকে। ওরা ভুলে যায় পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী বাঙালী কখনই ওদের অনৈতিক চাপিয়ে দেয়া শাসন মানবে না। ওরা কেমন করে ভাবতে পারল যারা ভাষার জন্য জীবন দিতে পেরেছে তারা সবক্ষত্রে ওদের দমননীতি মেনে চলবে? পাকিস্তানীদের প্রভুত্ববাদিতা বাঙালীরা মানবে? এটা কোন স্বাধীনতাকামী জাতি মানতে পারে না। এখানে একটা আশ্চর্যের বিষয় লক্ষণীয়, পাকিস্তান ভাগ হয় ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে। ইসলাম ধর্মের মূল বাণীই হলো মানবতা, ন্যায়পরায়নতা, অন্যের অনুভূতিকে সম্মান দেয়া, নিজে কম ভোগ করে অন্যের জন্য বেশি সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করা অথচ পাকিস্তানীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী কাজ করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার হরণ করে নিচ্ছিল। ইসলামের নামে অনইসলামিক জুলুম, আমাদের অধিকার, ন্যায্য প্রাপ্যতা থেকে আমাদের বঞ্চিত করে ওদের আধিপত্য চাপিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছিল। এটাতো ছিল ধর্মের নামে ডাকাতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাঘরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ল না। ওদের অধীনে ইলেকশন হলো, তারপরও ওরা অস্ত্রের মুখে এদেশ শাসন করার চেষ্টা করল। সর্বোপরি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। নিরীহ স্বাধীনতাকামী মানুষকে নির্বিচারে শহীদ করল। আমাদের অধিকার আমাদের না দিয়ে, অস্ত্রের মুখে আমাদের দমাতে চেয়েছিল। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। মা-বোনদের ইজ্জত, লাখো বাঙালীর জীবন, সাধারণ মানুষের ঘর দরজা-পোড়ানোসহ এহেনও কোন খারাপ কাজ ছিল না যা পাকিস্তানীরা করেনি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। জীবন দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ আগুনঝরা বসন্তে শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম বৈসম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় আদায়ের সংগ্রাম। জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমরা ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত, কোটি মানুষের মানসিক বিড়ম্বনা, ঘর-বাড়ি পোড়ানো সব কিছুর বিনিময়ে পাই একটি স্বাধীন দেশ, একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে আমরা স্বাধীনতা পাই। দেশ উন্নত হচ্ছে, উন্নত হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রশ্ন আজও মনে জেগে ওঠে আমাদের আজকের বাংলাদেশের, আমাদের কাজকর্ম, আমাদের নৈতিকতা যে ধারায় চলছে তাতে কি ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে? আজও কেন চারদিকে হাহাকার? মানবতা লুণ্ঠিত? সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবিহীন জীবন? ধোঁকা আর মিথ্যার ব্যাসাতি কি জাতীয়ভাবে আমাদের ঝেঁকে ধরছে? কেন আজও অলিতে-গলিতে নিষ্পাপ শিশুর মৃতদেহ আর লাশ অহরহ ভেসে ওঠে। কি করুণ-নির্মম বিভৎসতা আমাদের বিবেক আর মানবতাকে গ্রাস করল। আমরা কি জাতিগতভাবে স্বাধীন চিন্তাযুক্ত, না-কি স্বাধীন চিন্তাচেতনা কোন মিথ্যার অন্তরালে ঢাকা পরে যাচ্ছে? আজ বলব এ স্বাধীনতা মাসে আমাদের বিবেক যেন জাগ্রত হয় ন্যায় ও সত্যের পথে। মিথ্যার কোন ছলনায় শহীদের আত্মা শান্তি পাবে না। শহীদের আত্মা পবিত্র, সে আত্মার মৃত্যু নেই, কোন মিথ্যার বাণীতে তা শান্তি পায় না। স্বাধীনতার এ মাসে আমাদের শপথ হোক সততা, ন্যায়পরায়নতা, সঠিক বিবেক দ্বারা চালিত হওয়ার আত্মপ্রত্যয়। ছবি : অনিক ইসলাম মডেল : ইমি ও শাওয়ন পোশাক : কেক্র্যাফট মেকআপ : পারসোনা
×