ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

২০২১ সালের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৪ মার্চ ২০১৬

২০২১ সালের বাংলাদেশ

(১৩ মার্চ চতুরঙ্গ পাতার পর) রাজনীতিতে ইতিবাচক সুবাতাস : অর্থনীতির উপর প্রভাব ২০১৫ সালের সূচনাটি মোটেও সুখকর হয়নি। ২০০৮ সালে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতায় সাধারণ নির্বাচন করতেই হতো। প্রচ- বেআইনী প্রতিরোধ ও হানাহানির মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে সে নির্বাচন যথা মেয়াদে অনুষ্ঠিত হয়। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ৬ জানুয়ারি তারিখে ‘আন্দোলন’ শুরু করে। অবরোধ ও হরতাল হয় এর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু অধিকাংশ নেতা থাকেন পর্দান্তরালে। সে সুযোগে এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের ছত্রছায়ায় একাত্তর সালের পরাজিত শত্রুরা জঙ্গী, সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও খুনীরা গ্রেনেড, অগ্নি, হত্যা, গুম, ধ্বংস, ককটেল অস্ত্র ব্যবহার করে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিএনপি চেয়ারপার্সন ৫৯ জন সহকর্মীসহ ৯৩ দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন নিজেকে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, নিহত হন শতাধিক, ধ্বংস হয় মূল্যবান ধন-সম্পত্তি, ধীর গতি হয়ে পড়ে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা, হুমকির মুখে পড়ে দেশের ভাবমূর্তি। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি অফিসে ‘অবরুদ্ধ’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতই পাননি; তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় দরজা থেকেই। ঘটে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা কর্তৃক বহু চেষ্টার পর টেলিফোনে সংলাপ আমন্ত্রণে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পুনরাবৃত্তি। এদিকে সহিংসতা বন্ধ করার ঘোষণা না দিয়েই স্বার্থান্বেষী মহল সিভিল সোসাইটি নাগরিক সমাজ সংলাপের ডাক দিতে থাকে, এক এগারোর প্রেতাত্মারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল অকেজো রাষ্ট্রে পরিণত করার সব চেষ্টাই করেছে। তবে পরিস্থিতির স্বস্তিদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আদালতের শরণাপন্ন হয়ে জামিন নিয়ে বাসভবনে ফিরে যাবার মাধ্যমে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সকল গঠনমূলক কর্মকা-ে আসে প্রচ- গতি। ২৭ এপ্রিলের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লড়াই জমে উঠেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের ভোটযুদ্ধে। দেশী-বিদেশী সকল মহলকে অবাক করে দিয়ে বেলা এগারোটায় বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়। ফলাফল কিন্তু দুই বড় দলের মধ্যে ২-১ বা ১-২ জয়-পরাজয়ে ভাগাভাগি হতো কি না তা বলা মুশকিল। ৩০ ডিসেম্বরের ২৩৬টি পৌরসভা নির্বাচনেও বিএনপিসহ সকল দল অংশগ্রহণ করে। কিছু অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যভাবে শেষ হয়। এর পর থেকে বিএনপি গঠনমূলক রাজনীতিতে চালিত হচ্ছে। আসন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনেও বিএনপি অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে। সুষ্ঠুভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করতে পারাটা নির্বাচন কমিশনের যেমন একটি চ্যালেঞ্জ তেমনি অগ্নিপরীক্ষা দেশের টেকসই সুস্থির গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যও। লক্ষণীয় যে, ঐ পৌরসভাসমূহের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শতকরা ৫১ ভাগ আর বিএনপি শতকরা ২৮ ভাগ ভোট লাভ করে। বিগত কয়েকটি সাধারণ নির্বাচনের ফল থেকে বিশেষজ্ঞগণের হিসাব, জাতীয়ভাবে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮-৩৯ আর বিএনপি ৩৪-৩৫ ভাগ জনসমর্থনের অধিকারী। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট লাভ করে। এক এগারোর দুরভিসন্ধিমূলক যড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দেয় জনগণ। ২০১৪ ও ২০১৫-এর নাশকতামূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে বিএনপি সম্পৃক্ততার সন্দেহের কারণে সাময়িকভাবে দলটির ভোটের অংশ কমে থাকতে পারে। তবে সম্প্রতিকালে বিএনপি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারায় গণতন্ত্রমনা দেশবাসী স্বস্তির নিঃশাস ফেলেছে। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি দুটো বড় রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানে শঙ্কার সৃষ্টি হলেও উভয় দলই পিছু হটে; স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন দেশবাসী। তবে জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপমানজনক বক্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদানদের প্রতি অবজ্ঞা অপমান থেকে দলটিকে দূরে থাকতে হবে। বিএনপি তার কাউন্সিল অনুষ্ঠান করার জন্য কাক্সিক্ষত স্থানটি পেয়েছে, এটি একটি শুভ ঘটনা বটে। বাংলাদেশ ও বিশ্ব উপলব্ধি জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ এবং ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন’ পুরস্কারে ভূষিত করে। তাছাড়াও তাকে খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যে এফএও পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওয়াশিংটনের দ্য ফরেন এ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন চিন্তাবিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৩তম স্থান দিয়ে বিরল সম্মানে দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে। জঙ্গীঁবাদের বিরুদ্ধে তার আপোসহীন ও অকুতোভয় সংগ্রামের কারণে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরসনে তার উদ্ভাবনী নেতৃত্বের কারণেই শেখ হাসিনা এ সকল সম্মান অর্জন করেন। বিশ্বব্যাংকের বোকামিপ্রসূত ঋণ প্রত্যাহারের অন্যায্য নোটিসকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অসমসাহসী নেতৃত্বে শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেন। ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে প্রায় ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করা হয়। প্রমত্ত ও উত্তাল পদ্মা শেষ পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারা যাবে। পরিকল্পিত সময়ের আগেই ২০১৮ সালে সেতুর কাজ সমাপ্ত হবে বলে বিশ্বাসÑ দক্ষিণ বাংলার বিশাল সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভার মূলধারায় সংযুক্ত হয়ে আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির পালে নতুন শক্তি জোগাবে। স্মর্তব্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০-২০১৫ মেয়াদের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্টস গোলস এবং ২০১৬-২০৩০ মেয়াদের সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস প্রণয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই এসডিজি দলিলে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা রয়েছে। সরকারকে তার করণীয় করে যেতে হবে। রাজপথের বিরোধী দলকেও তার দায়িত্বপূর্ণ আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও জনপ্রশাসন ২০১৫ সালে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিশ্ব পরিম-লে নন্দিত হয়েছে। দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অব পিস ২৩টি বিবেচনা ক্ষেত্রে ১৬২টি দেশে যে জরিপ সম্পন্ন করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম (শ্রীলঙ্কা ১১৪, ভারত ১৪৩, পাকিস্তান ১৫৪)। পক্ষান্তরে শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এঅখখটচ ঝটজঠঊণ ১৪১টি দেশে জরিপ চালিয়ে যে ফলাফল পেয়েছে তাতে দেখা যায় যে, সিঙ্গাপুর (৮৯ পয়েন্টস), উজবেকিস্তান (৮৮), হংকং (৮৭), ইন্দোনেশিয়া (৮৭), শ্রীলঙ্কার (৭৯) পরেই ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ নিরাপদতম দেশ বাংলাদেশ। শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার সকল প্রচেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়েছে এসব মূল্যায়ন তারই সাক্ষ্য বহন করে। চলবে... লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
×