ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

রিজার্ভের টাকা চুরি, আঙ্গুলের ছাপ এবং আমাদের সাংবাদিকতা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৪ মার্চ ২০১৬

রিজার্ভের টাকা চুরি, আঙ্গুলের ছাপ এবং আমাদের সাংবাদিকতা

একসঙ্গে অনেক বিষয় চলে এসেছে। একদিকে বাংলাদেশের কোষাগার থেকে টাকা চুরি গিয়েছে, অন্যদিকে দেশে চলছে মোবাইল ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশনের বহুল প্রচারণা এবং আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ নিয়ে বিভ্রান্তি। সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি অন্তর্নিহিত বিষয়ও ফুটে উঠেছে। বিষয়গুলো ইন্টারেস্টিং। দেখা যাক বিষয়গুলো কতটুকু পরিষ্কার করা যায়। কোষাগারের টাকা চুরি বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রের কোষাগার হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকার ‘ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্ক’। সেই কোষাগার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রয়োজন মতো টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে দিয়ে থাকে। সেই লেনদেন হয় ইলেক্ট্রনিক্যালি। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস থেকে নির্দেশ পেলেই নিউইয়র্কের ওই ব্যাংক কাউকে টাকা প্রদান করে থাকে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে একইভাবে নির্দেশ যায় নিউইয়র্কে। মোট ৩৫টি নির্দেশনা পাঠানো হয়। তার ভেতর ৫টি নির্দেশেই চলে যায় ১০১ মিলিয়ন (১০ কোটি ১০ লাখ) ডলার। ৫টি নির্দেশ পরিচালনা করার পরই ফেডারেল ব্যাংকের সন্দেহ হয় যে, ট্রানজেকশনগুলো সন্দেহজনক। তাই তারা পরের নির্দেশগুলো আটকে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁচে যায়। এখন পর্যন্ত ঘটনা যেটুকু জানা গেছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ হলোÑ প্রথমেই সেই টাকা দেয়া হয় আমেরিকার স্থানীয় তিনটি ব্যাংকে, যে ব্যাংকগুলোতে আগেও টাকা দেয়া হয়েছে এবং এমন সব খাতে টাকা পাঠানো হয় যেগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা পাঠিয়ে থাকে। তারপর সেই স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে দেয়া হয় শ্রীলঙ্কায় এবং ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনে। শ্রীলঙ্কার ওই টাকার বিস্তারিত কিছু এখনও জানা যায়নি। তবে ফিলিপাইনের টাকার কিছু বিবরণ পাওয়া গেছে। ওখানকার টাকা প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় যারা বিদেশী মুদ্রা বিনিময় করে তাদের কাছে। তাদের মাধ্যমে ফিলিপাইনের নিজস্ব মুদ্রা পেশোতে কনভার্ট করা হয়। তারপরেই সেই টাকা ঢেলে দেয়া হয় তিনটি ক্যাসিনোতে। জুয়ার টাকার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয় সেই বিশাল অংকের টাকা। তারপর ক্যাসিনো থেকে নতুন করে টাকা তুলে সটকে পরে দলটি। কালো টাকা সাদা হয়ে যায়। অনেক মিডিয়া বলছে, সেই টাকা পরে হংকংয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফিলিপাইনের স্থানীয় মিডিয়া বলছে, পুরো এই কাজের জন্য ছয়জন হ্যাকারকে শনাক্ত করেছে ওখানকার সরকার। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে, তাদের কোষাগার থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে গেছে। তারপর তারা মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইন সরকার, সুইফট এবং ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। কিছু টাকা ইতোমধ্যেই উদ্ধারও হয়েছে বলে জানা গেছে। সময় যত যাবে, এর বিস্তারিত তত জানা যাবে। কেউ বলছেন, বিদেশ থেকেই আমেরিকার সিস্টেম ভেঙ্গে হ্যাকাররা টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে। তাহলে দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়, আমেরিকার ওই ব্যাংকের। কেউ ভাবছেন, সুইফট নেটওয়ার্ক হ্যাক করে তার ভেতর দিয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল। আবার তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে তারপর সেখানে থেকে নির্দেশনা পাঠানো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শেষের এই ঘটনাটিই ঘটেছে এবং সেটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে জ্ঞাতসারে হোক, আর অজ্ঞাতসারেই হোক স্থানীয় মানুষজন এর সঙ্গে জড়িত। অজ্ঞাতসারে বললাম এই কারণে যে, অনেক সময় অনেক তথ্য আমরা শেয়ার করি, কিন্তু বুঝতে পারি না সেটা অন্য কেউ কিভাবে ব্যবহার করবে। এমন আশঙ্কাকে একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এই ঘটনার ফলে পুরো ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। জনগণের মনে এক ধরনের ভয় তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, যদি ফেডারেল রিজার্ভ থেকেই টাকা চুরি হয়ে যেতে পারে তাহলে তাদের এ্যাকাউন্টের টাকা কতটা নিরাপদ? তাহলে কি তাদের টাকাও চুরি হয়ে যেতে পারে? কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের বেশ কিছু এটিএম মেশিন থেকেও জালিয়াতি করে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখন আবার আরও বড় আকারের টাকা চুরি! তাহলে হচ্ছেটা কি? বাংলাদেশ সবেমাত্র ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। এর অনেক কিছুর সঙ্গেই জনগণ যেমন পরিচিত নন, তেমনি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও অভ্যস্ত নয়। আমি বলছি না, টাকা চুরি যাওয়ার ঘটনাটি সামান্য। আমি বলছি, এই ধরনের কিছু ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। এটাই যে শেষ ঘটনা তা নাও হতে পারে। ভবিষ্যতে আরও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, দুষ্ট লোকগুলো প্রথমেই হানা দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এটাই প্রথম টার্গেট। এটা যে কেবল বাংলাদেশে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমেরিকা ইউরোপে এমন ঘটনা শত শত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাল-ভাত। তারা এটাকে মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে গেছে। একটি সমাজে ১ ভাগ মানুষ খারাপ কাজ করবে বলে বাকিরা সেটা থেকে দূরে থাকবে, সেটা হয় না। বরং দিনকে দিন নিরাপত্তার বিষয়গুলো আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের সবাই চিৎকার করছেন, সব গেল সব গেল। আমি সেভাবে চিৎকার করার পক্ষে নই। আমি বিশ্বাস করি, প্রযুক্তির দিকে আমাদের এগোতেই হবে এবং এটাকে আরও বেশি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের ভয়কে দূর করতে হবে। মানুষ আরও বেশি সচেতন হবে এবং একটা সময়ে গিয়ে মানুষ এর চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে ফেলবে। প্রযুক্তি দিয়েই এ ধরনের ক্রাইমকে ঠেকাতে হবে। আমাদের আরও বেশি বেশি প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে, যেন এই ধরনের দুর্ঘটনা কমে আসে। আবারও বলছি, এই ধরনের ঘটনাকে একদম বন্ধ করা যাবে না। আমরা শুধু এর সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আর যারা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা একটাও ঘটবে না, তারা আসলে প্রযুক্তির মূল বিষয়টিই জানেন না। তাদের বলব, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন প্রতিবছর কত বিলিয়ন ডলার আমেরিকাতেই ডিজিটাল উপায়ে জালিয়াতি হয়। তবে এই ধরনের ঘটনা থেকে আমরা আরও বেশি সজাগ হব, এটাই প্রত্যাশা। হাতের আঙ্গুলের ছাপ বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে প্রতিটি সিম কার্ড নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করছে। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশে ১২ কোটির মতো সিম কার্ড বিক্রি করেছে সব মোবাইল ফোন অপারেটর। কিন্তু সব সিম কার্ড চালু নেই। এবার রেজিস্ট্রেশন শেষ হলে বুঝা যাবে, কতগুলো ভাল সিম আমাদের দেশে আছে। বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে তার ভেতর সবচেয়ে ভাল কাজ হলো সিম কার্ড রেজিস্ট্রেশন। এর থেকে ভাল কাজ প্রযুক্তি খাতে আর কী হচ্ছে আমার জানা নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব ছিল গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তারপর সিম কার্ড বিক্রি করা। বিগত ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এই নিয়মটি মানছিলেন না। কিন্তু লাইসেন্সের নীতিমালায় পরিষ্কার করে বিষয়টি বলা রয়েছে। এই যে তারা নিয়মটি মানেননি, এর জন্য সিমপ্রতি তাদের একটি জরিমানা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কোন আইন অমান্য করলে কত জরিমানা সেটার একটা নিয়ম রয়েছে। সেটা কেন পালন করা হলো না এবং এখনও হচ্ছে না- তা বোধগম্য নয়। তারানা হালিম মন্ত্রী হয়ে যোগ দেয়ার পর তিনি যে শক্ত হাতে কাজটি করছেন তার তুলনা নেই। অনেকেই চাইবেন না, তার এই উদ্যোগ সফল হোক। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমি চাই, তিনি এই কাজে সফল হন। দেশ অনেকটা পথ এক ধাপে এগিয়ে যাবে। তবে জনমনে দ্বিধার জন্ম হয়েছে যখন মিডিয়াগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে যে, মোবাইল অপারেটরগুলো প্রতিটি গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ নিজেদের ডাটাবেজে সংগ্রহ করছে। কোন কোন অপারেটর টিভি ক্যামেরার সামনেই বলেছেন যে, তারা গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ জমা রাখছেন। কিন্তু বিটিআরসি এবং সরকার বার বার বলছে যে, আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করা যাবে না। এই দুই অবস্থানের কারণে মানুষ কনফিউজ হয়েছে। বিটিআরসির মতো আমিও বিশ্বাস করি, গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করার অধিকার মোবাইল অপারেটরদের নেই। যেই অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি, সেটা তারা কেন ব্যবহার করবেন? এটা ঠিক যে, মোবাইল অপারেটরগুলো চাইলেই আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে তারপর সেটা ম্যাচ করিয়ে আবার সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্তু তাদের বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের তৈরি করা যে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেজ আছে, তার সঙ্গে অনলাইনে ম্যাচিং করা যাবে। সংরক্ষণ করা যাবে না। সংরক্ষণ করার অধিকার কেবল রাষ্ট্রের। পুরো পৃথিবীতেই এখন ইন্টারনেট এবং প্রাইভেসি নিয়ে কাজ হচ্ছে এবং ইউরোপ/আমেরিকায় গুগলের মতো কোম্পানিকে প্রাইভেসি ভাঙ্গার জন্য বেশ কয়েকবার জরিমানা করা হয়েছে। এমন কি ভারতেও এই আইন অনেক বেশি শক্তিশালী। একজন গ্রাহকের অতি ব্যক্তিগত তথ্য তার অনুমতি ছাড়া যেমন সংগ্রহ করা যাবে না এবং সেটা সংরক্ষণও করা যাবে না। আর সেটা যদি কোনদিন প্রকাশিত হয়ে যায়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশি জরিমানা গুনতে হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস হলো প্রাইভেসিকে তোয়াক্কা না করা। আমরা যে নিত্যদিন অন্য মানুষের প্রাইভেসিতে আঘাত করছি, এটা আমাদের ব্রেইনে আসেই না। কারও ব্যক্তিগত কথোপকথন (কখনও সত্য, কখনও মিথ্যা) জাতীয় প্রচার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে প্রচার করে আমরা এক ধরনের সুখ পাই। আমরা অন্যের প্রাইভেসি ভেঙ্গে নিজেদের এক ধরনের নোংরা তৃপ্তিতে সিক্ত করি। এগুলো নিচু স্তরের মানসিকতার পরিচয় বহন করে। কোন সভ্য মানুষ এটাকে গ্রহণ কিংবা সমর্থন করতে পারে না। এটার পক্ষে যদি কেউ কথা বলতে আসে, তার সম্পর্কে আমার ধারণা হবে খুবই নিচু প্রজাতির জীব হিসেবে। তার থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় হবে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাজ হলো, তারা একটি মেশিন দিয়ে আঙ্গুলের ছাপটি নেবে এবং সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। যদি মিলে যায়, তাহলে তার সিমটি রেজিস্ট্রেশন করে দেবে। না মিললে, দেবে না। এখানে সংরক্ষণ করার মতো ঝুঁকি তার নেয়ার কথা নয়। ঝুঁকি বলছি এই কারণে যে, এই বিশাল অংকের আঙ্গুলের ছাপ যেহেতু ডিজিটাল আকারে রাখা হবে, তাই এটা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই যে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি হয়ে গেল, এটা ডিজিটাল সিস্টেমের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এর থেকে তো সবার বুঝা উচিত, এই ডাটা সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে কি ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে। অনেকেই বলছেন, আমরা তো আগে যখন সিম কিনেছি তখন কাগজে আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছি। কাগজে আঙ্গুলের ছাপ দেয়া, আর ডিজিটাল সিস্টেমে আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার পার্থক্য যদি কেউ করতে না পারেন, তাহলে তার সঙ্গে যুক্তিতর্কে পারা যাবে না। গায়ের জোর যাকে বলে আর কি! তবে শুধু এটুকু বলে রাখি, আমার কাছে যদি কয়েক লাখ মানুষের আঙ্গুলের ছাপের ডিজিটাল কপি থাকে, সেটা দিয়ে আমি লংকাকা- বাঁধিয়ে দিতে পারব। যারা মনে করছেন, এটা কোন ব্যাপারই না, তারা মূর্খের মতো কথা বলছেন। এই দেশে এমন মূর্খের সংখ্যাই বেশি। আমাদের পরিবর্তিত সাংবাদিকতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির বিষয়টি মিডিয়া খুব কঠিনভাবে নিয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় দেখে আমি আশাহত। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা ঘটে এই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা টের পায় ৮ ফেব্রুয়ারি। আর বাংলাদেশের মিডিয়া এটা জানতে পারে ২৯ ফেব্রুয়ারি, তবে বাংলাদেশ থেকে নয় ফিলিপাইনের একটি মিডিয়া ‘ইনকুয়ারার’ যখন সেটাকে হেডলাইন করেছে তখন। যেদিন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো এটাকে হেডলাইন করে, সেদিন বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আমার মিটিং ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে আছেন এবং একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। সেই মিটিংয়ে আরও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিলেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেব ভীষণ মর্ম বেদনা নিয়ে বললেন, এটা যদি সঠিক হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাহলে আমি শেষ বয়সে এসে আর মুখ দেখাব কিভাবে? এই গ্লানি নিয়েই হয়ত আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শেষ করতে হবে! আমি মোটামুটি নিশ্চিত, অনেক পাঠকই বিষয়টি ধরতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সমস্যাটা কোথায়! সমস্যাটা হলো, তিনি তার ওই পেশাটাকে সম্মান করেন। তিনি দেখতে চান, যেই পেশায় তিনি তার জীবন দিয়ে দিয়েছেন সেখানে কোন কলঙ্ক নেই; বিশ্বাস আর নির্ভরতার জায়গা হলো ব্যাংকিং সেক্টর। তিনি এই সেক্টরে কাজ করেন, এটা মানুষের কাছে বলতে যতটা গর্ব করতেন, এরপর থেকে হয়ত সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে, যেমনটি হয়ে গেছে আমাদের টেলিকম খাত। একটি মানুষ তার পেশাকে, তার সেক্টরকে এভাবে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, ভালবাসে- এটা দেখে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কিন্তু এই অনুভূতিগুলো বাংলাদেশে বিরল। নিজের প্রফেশনের প্রতি তাদের নিজেদের দায়িত্ব আছেÑ এমন মানুষ আমি খুব একটা পাইনি। এখনও খুব একটা দেখি না। তেমনি আরেকটি ক্ষয়ে যাওয়া খাত হলো সাংবাদিকতা। এই যে মিডিয়া এখন এটা নিয়ে এতো সোচ্চার হয়েছে, কিন্তু কেউ তো জিজ্ঞেস করছে নাÑ বাংলাদেশের মিডিয়া কেন বিষয়টি আগে জানতে পারেনি? কেন ফিলিপাইনের একটি সংবাদমাধ্যম থেকে আমাদের এটা জানতে হলো? আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো তাহলে কি করে? ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম বাংলাদেশ থেকে উঠে গেছে। এটাই তার বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর একটি বড় অংশ ‘ডে কভারেজ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোথায় কি হচ্ছে, আর কে কি বললেন- এটাই তো আমাদের নিউজ। এর বাইরে কি আর কিছু আছে? জি আছে। একে অন্যের পেছনে লাগা। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো যেহেতু এখন বিভিন্ন ব্যবসায়িক হাউসের কাছে চলে গেছে, তাই ওখানে তাদের স্বার্থকেই বড় করে দেখা হয়। সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা মরে গেছে এই দেশে এবং এটা নিয়ে আমাদের কারও কোন আক্ষেপটুকু পর্যন্ত নেই। এটাকেই আমরা মেনে নিয়েছি। একজন সাংবাদিককেও আমি দেখিনি যে বিষয়টি নিয়ে লজ্জা পেয়েছেন। বরং তারা একে অপরের পিঠ চুলকানিতেই বেশি ব্যস্ত। এই সাংবাদিকতা হবে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ? অসম্ভব! বাংলাদেশে সৎ এবং ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতা আর সহসাই আসছে না। (দু’একটা কর্নার কেস কোন উদাহরণ নয়)। এর জন্য যে কালচারের প্রয়োজন হয়, সেটা নেই। আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সাংবাদিকরা আগে যে ঝুঁকি নিতেন, তা এখন আর নেন না এবং নেয়ার সুযোগও নেই। সাংবাদিকতা আমার কাছে সবচেয়ে মহৎ পেশা বলে মনে হয়। আমাকে যখন কোন সাংবাদিক সাক্ষাতকারের জন্য আসেন, আমি তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করি, আপনি কোন্ সাবজেক্টে লেখাপড়া করেছেন? তাদের বেশিরভাগ উত্তর দেয়, সাংবাদিকতা। আমি বলি, তাহলে তো এটাই আপনার আসল পেশা। কেমন লাগছে বর্তমান পরিস্থিতি? তারা মুখটা মলিন করে বলেন, এমনটা হবে বুঝতে পারিনি। আমি তাদের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আর মনে মনে বলি, প্রভু, যে স্বপ্ন নিয়ে এই তরুণ ছেলেমেয়েগুলো পথে নেমেছে তুমি তাদের পাশে থেক। এরা যেন পথটা হারিয়ে না ফেলে কোনদিন। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×