ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেন্টমার্টিন ॥ পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৩ মার্চ ২০১৬

সেন্টমার্টিন ॥ পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের সাগরের তলদেশে রয়েছে মনোমুগ্ধকর বিচিত্র প্রাণী ও হরেক রকম জীব। আরও আছে নানান আকারের পাথরের স্তূপ, দুর্লভ প্রবাল, দৃষ্টিনন্দন পাথরের ফুল। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে প্রচুর চুনাপাথরসহ নানা প্রকার পাথর, রেডিয়াম, সামদ্রিক শৈবাল, ঝিনুক, মুক্তা ও সিলিকন পাওয়া যায়। সাগরের তলদেশে এসব বিচিত্র জীব অবাক হওয়ার মতো, দেখলে মনে হবে সাগরের তলদেশে রয়েছে স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যময় এক জগত। রূপবৈচিত্রের অনন্য মহিমায় রূপবতী সেন্টমার্টিন দ্বীপে চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ করে নবেম্ব^র থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিস, হরেক রকম সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ আর প্রবাল অন্যতম আকর্ষণ ও অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় সেন্টমার্টিন্সের পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেনÑ এস এম মুকুল বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দক্ষিণাংশের মূল ভূখ- বদর মোকাম থেকে ১৪ কিঃ মিঃ দক্ষিণে দ্বীপটির অবস্থান। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের প্রায় ৮ কিঃ মিঃ পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় বাংলাদেশে একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বালি পাথর প্রবাল কিংবা জীববৈচিত্রের সমন্বয়ে ভ্রমণ পিপাসুদের মনোরম আকর্ষণীয় অবকাশ কেন্দ্র সেন্টমার্টিনের আয়তন মাত্র ৮ কি. মি। দ্বীপটি জোয়ারের সময় মাত্র ৫ কিঃ মিটারে সঙ্কুচিত হয়। যেভাবে আবিষ্কার ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ইতিহাস থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে আমেরিকান নাবিক ঈযৎরংঃড়ঢ়যবৎ ঈড়ষঁসনঁং যখন এই দ্বীপটি আবিষ্কার করেন তখন এর নাম দেয় ‘ষধহফ ড়ভ ংধষঃ’ লবণ দ্বীপ। প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে কিছু আরব বণিক বাণিজ্য করতে মিয়ানমারে এসে উপস্থিত হতো। সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্য সফরে তারা মাঝে মাঝে এই দ্বীপে বিশ্রাম নিত। আরব বণিকরা এই দ্বীপের নাম রাখে জাজিরা। পরবর্তীতে ইংরেজরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে তখন এর নাম হয় সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। স্থানীয় জনগণ একে বলে থাকে নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনি দ্বীপ। জীবন-জীবিকা প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক আসা-যাওয়া করে। পর্যটকদের থাকার জন্য দ্বীপটিতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮৮টি হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। ১৯৭২ সালে যেখানে ১১২টি বসতি ছিল বর্তমানে সেখানে দেড় হাজার পরিবারের প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ বসবাস করছে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। এখানকার মানুষ মূলত মৎস্য শিকার করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হওয়ায় অনেকেই রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল কিংবা গ্রোসারি শপের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো, এ দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। সেন্টমার্টিন দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৬৫০০ জন। হতে পারে ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’ সারি সারি নারিকেল গাছ আর প্রবালসহ বাহারী জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন হতে পারে ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’। দ্বীপবাসীকে সম্পৃক্ত করে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু নীতিমালায় মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে এখানে পর্যটন শিল্প বিকাশে উদ্যোগ নেয়া হলে দ্বীপটি হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। সবুজ শ্যামল বৃক্ষবেষ্টিত সাগর বুকে ভাসমান অনন্য শোভা ম-িত এই সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনের উভয় প্রান্তে ছোট বড় ৩৭টি সৈকত রয়েছে যা ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে। শীত মৌসুমে দিনে তিন থেকে চার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাচ্ছেন, রাতে থাকছেন। আয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রবাল দ্বীপে শৈবাল সম্ভাবনা ‘সামুদ্রিক শৈবাল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। শৈবালে দুধের চেয়েও ১০ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে। শৈবালেই সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি আয়োডিন রয়েছে, যা ওষুধ বা লবণের চেয়েও সমৃদ্ধ বিকল্প হতে পারে। বিজ্ঞানীদের দাবি সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় দুইশ’ প্রজাতির জীবের উপস্থিতি রয়েছে। যার অধিকাংশ মানুষের খাদ্যসহ হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্যতৈরিতে ব্যবহার করা যাবে। এই দ্বীপে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। শৈবাল বিদেশে রফতানি করেও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণত চার ধরনের প্রবাল সংগ্রহ করা হয় যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পাতাফুল, গাছফুল, শৈবাল ও মগ। এদের মধ্যে গাছফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাহারী অলংকার প্রস্তুতের জন্যেই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। মাছের পাশাপাশি এ সামুদ্রিক শৈবাল চাষ এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। পরিকল্পিত বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আশার খবর হলো- সেন্টমার্টিনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন হবে সামুদ্রিক শৈবাল ভা-ার। জানা গেছে, বর্তমানে ১৮০ জন চাষী ১০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ শহরের শাহ্পরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়া এলাকায় নাফ নদীর তীর এবং উখিয়ার ইনানী এলাকার রেজু খালের তীরে শৈবাল চাষ করছেন। এসকল চাষী বছরে দুটি প্রজাতির ৪০০ থেকে ৫০০ মণ শৈবাল উৎপাদন করছে। অনেক চাষী প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত আরও প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার মণ শৈবাল সংগ্রহ করছে। চাষকৃত ও সংগৃহীত এসব শৈবাল শুকিয়ে ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব শৈবাল মিয়ানমার থেকে চলে যাচ্ছে চীনে। বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, সামুদ্রিক শৈবালে ওষুধী গুণাগুণ রয়েছে। তাই এগুলো ওষুধ কারখানায় এবং জৈব সার তৈরিতে বিভিন্ন দেশে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। প্রয়োজন ইকো-ট্যুরিজম এ দ্বীপে ভ্রমণে এসে যেন যে কেউ প্রকৃতির পরশে শিহরিত হয়ে উঠে। প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি পরিকল্পনায় রেখে অবকাঠামোসহ সব স্থাপনার নির্মাণশৈলী ও উপাদান হবে প্রাকৃতিক। এ লক্ষ্যে স্থানীয় জনবসতিসহ সরকারী-বেসরকারী স্থাপনাও গড়ে তুলতে হবে ইকো-ট্যুরিজমের আওতায়। এর ফলে যান্ত্রিক জীবনে অতিষ্ঠ মানুষ প্রকৃতির পরশ নিতে ছুটে আসবে সেন্টমার্টিন। আমরা জানি, প্রাণের যে বৈচিত্র্য রয়েছে দ্বীপগুলোতে, তাকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবি। সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হবে আমাদের স্বার্থেই। সেজন্য সর্বসাধারণকে সচেতন থাকতে হবে পরিবেশ বিষয়ে। পর্যটন আইন মেনে চলতে হবে। ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেলা যাবে না। স্থায়ী আবাসন কমাতে হবে। থাকার ব্যবস্থা বন্ধ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। পর্যটন পুলিশের সংখ্যা, বুথ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন গবেষক
×