ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হাতিয়ায় গণপিটুনিতে ৪ ডাকাতের মৃত্যু, পুলিশসহ আহত ৫

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৩ মার্চ ২০১৬

হাতিয়ায় গণপিটুনিতে ৪ ডাকাতের মৃত্যু, পুলিশসহ আহত ৫

নিজস্ব সংবাদদাতা, নোয়াখালী, ১২ মার্চ ॥ নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ধারালো অস্ত্রসহ পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গণপিটুিনতে সন্দেভাজন ৪ ডাকাতের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় পুলিশের ৩ কনস্টেবল ও ২ ডাকাত আহত হয়। শুক্রবার মধ্যরাতে বয়ারচরের চেয়ারম্যান ঘাট রিজার্ভ পুলিশ ক্যাম্প এলাকায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহত ও আহত ডাকাতদের ৫ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন, জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার বিশ্বাসপাড়া গ্রামের মোস্তফা কামালের ছেলে আবু বকর সিদ্দিক (২২), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাঠবাড়ি গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে সাইফুল ইসলাম সুজন (২২), চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বেলাল হোসেনের ছেলে আকবর আলী (২৪), আবুল কাশেমের ছেলে মোঃ সুমন (২২) ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড়ব গ্রামের নূর আলমের ছেলে আরিফুর রহমান (২২)। তবে এদের মধ্যে নিহত কোন চারজন তা নিশ্চিত করতে পারছে না পুলিশ। অপর দিকে আহত পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে রয়েছে কামরুল হাসান, জাহাঙ্গীর হোসেন ও ফজলুল হক। এর মধ্যে ফজলুল হক ও দুই ডাকাতকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশের অপর দুই কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম ও কামরুল হাসানকে সুবর্ণচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার আগেই ১০-১২ জনের একদল যুবক এম.বি আউলিয়া নামের একটি ইঞ্জিন চালিত ফিশিং বোট নিয়ে চেয়ারম্যান ঘাটে ভিড়ে। তারা কখনও দল বেঁধে আবার কখনও বিচ্ছিন্নভাবে ঘাট এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ঘোরাফেরা শুরু করে। কেউ কেউ মুদি দোকান থেকে খালি পাঠের বস্তা ও ফার্মেসি থেকে ওষধ কিনে নেয়। রাত প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে তাদের মধ্যে ছয়জন বাজারে ঘোরাফেরা করলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সন্দেহের উদ্বেগ হয়। পরে তাদের নাম, পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তারা একেক জন একেক ধরনের উত্তর দেয়। কেউ নিজেকে মাঝি, আবার কেউ কোস্টগার্ডের অফিসার, কেউ জাহাজের বড় কর্মকর্তা ইত্যাদি বলে পরিচয়। এক পর্যায়ে লোকজন স্থানীয় চেয়ারম্যান ঘাট রিজার্ভ পুলিশ ক্যাম্পে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে যুবকদের আটক করে। এমন খবর পেয়ে তাদের ট্রলারে থাকা অন্যরা পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ আটককৃত যুবকদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাদের তথ্য অনুযায়ী কিছু যুবককে বহনকৃত ট্রলারটি তল্লাশি করে পুলিশ। এতে বিভিন্ন রকমের ৭টি ধারালো অস্ত্র, বেশ কিছু কাঁচের বোতল, কয়েকটি লাইফ জ্যাকেট জব্দ করা হয়। এ ছাড়া বোটে রয়েছে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল, খাওয়ার পণ্য ও থাকার আসবাবপত্র। সূত্র জানায়, রাত প্রায় ১১টার দিকে পুলিশের চিৎকার শুনে পুনরায় আশপাশ থেকে লোকজন বের হয়ে আসে। দেখা যায় আহত তিন পুলিশ সদস্য ও অন্য পুলিশ সদস্যরা ডাকাতরা পালিয়েছে বলে চিৎকার দিচ্ছে। এমন সময় চারদিক থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে ঘেরাও করে ওই ছয়জনকে পুনরায় আটক করে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে আটককৃত ছয়জনকে গণপিটুনি দেয়। সরেজমিনে গেলে দেখা যায় চেয়ারম্যান ঘাট রিজার্ভ পুলিশ ক্যাম্পের জীর্ণদশা। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেন, ক্যাম্পে কিছুক্ষণের জন্যও আসামি রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে কোন হ্যান্ডকাপ বা বাঁধার দঁড়ি নেই। তাছাড়া রাত সাড়ে ১০টা থেকে পৌনে ১১টার মধ্যে স্থানীয় জেনারেটরের বিদ্যুত সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। নেই সৌর বিদ্যুত ব্যবস্থা। তারা সন্দেহভাজন ডাকাতদের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ছয়জনকে আটক করে ক্যাম্পে পুলিশ সদস্যদের আসবাবপত্র বাঁধার কিছু দঁড়ি দিয়ে তাদের বেঁধে রাখে এবং তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ধারালো অস্ত্রগুলো একই কক্ষের একটি টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা হয়। ওই সময় ৭-৮জন পুলিশ সদস্য ক্যাম্পে ছিল। এর মধ্যে অস্ত্র সাজিয়ে রাখা টেবিলের পার্শ্বে এক সদস্য ভাত খাচ্ছিলেন। ঠিক যখন রাত পৌনে ১১টা বাজে তখনই জেনারেটরের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ডাকাত সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে টেবিলে থাকা অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নেয় এবং এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিন পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং পুলিশদের থাকার চৌকি ভাংচুর করে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আহত ও অন্য পুলিশ সদস্যরা ডাকাত পালিয়েছে পালিয়েছে বলে চিৎকার দিলে চারদিক থেকে মানুষ বের হয়ে ঘেরাও করে ছয় সন্দেহভাজন ডাকাতকে গণপিটুনি দেয়। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বোটে তল্লাশি চালাতে যাওয়া ক্যাম্প ইনচার্জসহ অন্য পুলিশ সদস্যরাও দৌড়ে আসে। এ অবস্থায় পুলিশ ক্যাম্প থেকে বিষয়টি দ্রুত হাতিয়া থানা ও জেলা হেড কোয়াটারে জানানো হয়। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নোয়াখালী সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নবজ্যোতি খিসা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গণপিটুনিতে চার সন্দেহভাজন ডাকাতের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন নোয়াখালী সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নবজ্যোতি শিখা। গতকাল শনিবার তিনি বলেন গণপিটুনির পর গুরুতর আহত অবস্থায় তাদেরকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পথে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যও আহত হয়। এএসপি আরও বলেন, নিহত ও আহতদের মধ্যে পাঁচ জনের নাম পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তাদের মধ্যে কোন চারজন নিহত হয়েছে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ অল্প আলোতে প্রথম দফায় আটকের পরে পুলিশ সদস্যরা তাদের নাম ঠিকানা নিয়েছে। তাই চেহারার সাথে নাম মিলিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোঃ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে রাত দুইটার দিকে চারজনকে মৃত এবং দুইজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। এছাড়া আহত অবস্থায় এক পুলিশ সদস্যও রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিহতদের মরদেহ দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কিল-ঘুষি ও পিটুনিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আহত দুইজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আরিছুল হক বলেন, ঘটনাস্থল থেকে হাতিয়া থানা কমপ্লেক্স নদীর বহু দক্ষিণে। তারপরও ঘটনা অবহিত হওয়ার সাথে সাথে পার্শ¦বর্তী পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হয়েছে। শনিবার সকালে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, ডাকাতদের ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত বোটটি আটক করা হয়েছে এবং বোটে তল্লাশি চালিয়ে ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে।
×