ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান

দেশী-বিদেশীদের চক্রান্তে গণহত্যার বিষয়টি হারিয়ে যেতে বসেছিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৩ মার্চ ২০১৬

দেশী-বিদেশীদের চক্রান্তে গণহত্যার বিষয়টি হারিয়ে যেতে বসেছিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টায় ইতিহাস থেকে গণহত্যার বিষয়টি হারিয়ে যেতে বসেছিল। ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে গণহত্যার বিষয়টি আরও আড়ালে চলে যায়। পাকিস্তানপন্থীরা রাজনৈতিকভাবেও গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার দলের এক নেতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে সরকারকে দ্রুতই আইন পাস করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া, গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করতে ট্রাইব্যুনাল রাখতে হবে। এই হত্যাকারীদের কোনরূপ ছাড় দেয়া যাবে না, বয়স যতই হোক। গণহত্যার সর্বোচ্চ নয়, সর্বনিম্ন শাস্তি হতে হবে মৃত্যুদ-। শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা’র তৃতীয় সিরিজের দশটি বইয়ের প্রকাশনা ও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের উদ্যোগে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গণহত্যার ওপর ১ হাজার বই প্রকাশ করাই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভটি আগামী ১ মাসের মধ্যে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়। অনুষ্ঠানে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ’৭৫-এর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যার ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই অপচেষ্টা লেখনীর মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন মুনতাসীর মামুন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহঙ্কার, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সেসব তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করছে; যা এক কথায় অসাধারণ। মুনতাসীর মামুনের লক্ষ্য ১ হাজার বই প্রকাশ করা। আশা করা যায়, আমাদের জীবদ্দশাতেই তা দেখে যেতে পারব। মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে বা তাদের কাছ থেকে শুনে গণহত্যার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য একটি কাজ। তারা সে কাজটিই করছে। তিনি বলেন, গণহত্যাকারীদের অনেকেই এখনও নিজ নিজ এলাকায় বহাল তবিয়তে রয়েছে। ’৭৫-এর পর গণহত্যাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সর্বশেষ খালেদা ও তার দলের আরেক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকৃতি আইন প্রণয়ন করতে হবে। ইউরোপের ৩০টি দেশে হলোকাস্ট আইন আছে, হলোকাস্টকে কেউ যদি অস্বীকার করে তার শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশেও এরকম কিছু শাস্তির প্রয়োজন রয়েছে। আর যদি তা না হয়; একদিন পাকিস্তানপন্থীরা ’৭১-কেই নাকচ করে বসবে। বিচারকদের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, প্রশ্নটা হচ্ছে ন্যায়বিচারের, আমাদের বিচারকরা কেউ নিরপেক্ষ নন, তাদের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। একজন বিচারক কী করে মুক্তিযুদ্ধ নিরপেক্ষ হন? বিচার প্রক্রিয়ায় মনে রাখতে হবে এটা কোন সাধারণ বিচার নয়। গণহত্যার সর্বোচ্চ নয়, সর্বনিম্ন শাস্তি হতে মৃত্যুদ-। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নানা মাত্রা আছে। আমরা বিজয় দেখিনি, তাই ইতিহাস রচনায় বিজয়ের বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে গণহত্যার ইতিহাস অনেকাংশে আড়াল হয়ে গেছে। গণহত্যাকে রাজনৈতিকভাবেও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দেশীয় পাকিস্তানপন্থীরা গণহত্যাকে রাজনৈতিকভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। আবার বিদেশী ষড়যন্ত্রও ছিল, গণহত্যার বিষয় এলে আমেরিকা-চীন-সৌদি আরবের বিষয়টিও চলে আসে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকৃতি আইন পাস হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, আশা করছি সরকার দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধের অস্বীকৃতি আইন পাস করবে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নিতে সরকারকে বহুদিন যাবত বলে আসছি। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে মুনতাসীর মামুন বলেন, অনেকেই বলেন মূলদের তো বিচার হয়ে গেছে, বাকিদের আর কী দরকার! একজন যুদ্ধাপরাধীর বয়স ৮০ বছর হলেও তার বিচার করতে হবে। সুতরাং আমি মনে করি, ট্রাইব্যুনাল থাকতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তা চলতেই থাকবে। গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই প্রত্যেক নাগরিক বিচারক সম্পর্কে মন্তব্য করার অধিকার রাখেনÑ এমন মন্তব্য করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশে সবকিছু সম্পর্কে মন্তব্য করা গেলেও বিচারক ও আদালত সম্পর্কে মন্তব্য করা যায় না। গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের ট্যাক্সের টাকায় যারা চলবে তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে বলার অধিকার আমার আছে। আমি রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করতে পারব, প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে সমালোচনা করতে পারব, আমি অন্য কারও সমালোচনা করতে পারব নাÑ এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না।’ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক বিচারক সম্পর্কেও সমালোচনা করার অধিকার রাখেন। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আইনের একটা দর্শন রয়েছে। আমরা যদি এটা মনে রাখি বিচারকদেরও এটা মনে রাখতে হবে। আমরা এখানের মানুষ, তারাও এখানের মানুষ। বিচারকের আসনে বসে তাদের অবশ্যই ’৭১-এর কথা মনে রাখতে হবে। গণহত্যার বিষয়ে এমন একটি অবস্থানে যেতে হবে, যাতে বাংলাদেশে গণহত্যা সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে না পারে। ওই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ড. বোরহান উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কবি তারিক সুজাত ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ।
×