ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্র থেকে ভিডিও বার্তায় নির্দেশ যাচ্ছে নেতাকর্মীদের কাছে;###;যশোরে গোপন গুহা আবিষ্কারের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন

চোরাগোপ্তা হামলার বড় ধরনের ছক কষছে ক্যাডাররা ॥ জামায়াত শিবির এবার কৌশলী

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৩ মার্চ ২০১৬

চোরাগোপ্তা হামলার বড় ধরনের ছক কষছে ক্যাডাররা ॥ জামায়াত শিবির এবার কৌশলী

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কর্মসূচীতে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে গ্রেফতার না হয়ে ভিন্ন কৌশলে কাজ করছে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। হরতাল-অবরোধে প্রকাশ্যে নাশকতা কিংবা মিছিল- সমাবেশ করে গ্রেফতার হতে চায় না তারা। মামলা ও ধরপাকড়ের প্রেক্ষাপটে এবার আগের অবস্থান পরিবর্তন করে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। তবে গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে বড় ধরনের চোরাগোপ্তা হামলার ছক কষছে ক্যাডাররা। ‘কর্মসূচী দিলেও গ্রেফতার এড়াতে হবে। নিতে হবে বড় ধরনের আঘাতের প্রস্তুতি’- কেন্দ্র থেকে এমনই নির্দেশ গেছে নেতাকর্মীদের কাছে। জামায়াত নেতারা মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ ও নির্দেশ দিচ্ছেন ভিডিওবার্তায়। এদিকে যশোরে কার্যালয়ের পাশে বাগানের মধ্যে নাশকতা পরিকল্পনার উদ্দেশে শিবিরের গুহা তৈরির ঘটনা ধরা পড়ার পর নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গ্রেফতার এড়িয়ে বড় ধরনের নাশকতার কৌশল নেয়ার তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে ছিল। তবে যশোরের ঘটনা বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। যশোর পুলিশ বলছে, বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই শিবির কর্মীরা গুহা তৈরি করে। অবশ্য পুলিশের গোয়েন্দা সংবাদে শিবিরের সব পরিকল্পনা ভ-ুল হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর জন্য বুধবারের হরতালেও নাশকতার তথ্য ছিল। তাই ব্যাপক প্রস্তুত ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। জামায়াত এখন কৌশলী পাল্টেছে। তারা গ্রেফতার এড়াতে এখন গা-ঢাকা দিয়ে চলছে। এ কারণে চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কা বাড়ছে। জামায়াত ও শিবিরের সূত্রগুলো বলছে, রাজপথে শক্ত কোন কর্মসূচী পালন করে শীর্ষ নেতাদের মুক্তি বা সরকারকে দুর্বল করার কোন সম্ভাবনাই দেখছেন না দলটির নেতারা। তাই আপাতত নমনীয়ভাবে দলীয় কর্মসূচী পালন করার কৌশল নেয়া হয়েছে। সারা দেশের নেতাকর্মীকে এ কৌশলের কথা জানানো হয়েছে। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্বশীল একাধিক রোকন জানিয়েছেন, নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এখন হিসাব করে রাজপথে নামার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাস্তায় নেমে সংগঠনের শক্তি ক্ষয় করা যাবে না, বলা হয়েছে। তাই হরতাল দিলেই আগের মতো কেউ রাস্তায় নামতে রাজি নয়। ব্যক্তিগতভাবেও কর্মীরা অনেকে আটক হলে ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগে আছেন। মীর কাশেম আলীর রায়ের পরেও তাই এসব বিবেচনায় মাঠে নামেনি কেউ। রায় নিয়ে আমাদের তেমন ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করলেন সাতক্ষীরা জামায়াতের সাবেক এক আমির। বর্তমানে জামায়াতের এ রোকন বলছিলেন, আমাদের ওপর কেন্দ্রের নির্দেশ আছে যে সংগঠনকে শক্তিশালী করা, দাওয়াতি কাজ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। আপাতত রাজপথে কোন শক্তি ক্ষয় করার প্রয়োজন নেই। এ নির্দেশনা অনুযায়ী এলাকায় সাংগঠনিক কাজ বেশ জোরদার হয়েছে। ঝিনাইদহ সদরের এক নেতা জানান, বর্তমানে এ এলাকায় জামায়াতের কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। একই ধরনের নির্দেশনার কথা জানান জয়পুরহাট শিবির নেতারা। এদিকে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের জেলায় নেতাকর্মীদের গোপানে বৈঠক করে সুসংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর জামায়াত। সংগঠনটির নেতারা এজন্য কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। যেখানে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে কর্মীদের কাছে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। যেখানে নেতাকর্মীদের কাছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পার্টির আটক শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে পজিটিভ ধারণা দেয়া, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈরিতার পরিবর্তে কৌশলে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন তৈরিরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সারাদেশের নেতাকর্মীদের নেতারা একই সঙ্গে নির্দেশ দিচ্ছেন এই বলে যে, ‘কর্মসূচী আসবে। তবে কর্মসূচী দিলেও গ্রেফতার এড়াতে হবে। নিতে হবে বড় ধরনের আঘাতের প্রস্তুতি।’ সম্প্রতি আপীল বিভাগের রায়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ফাঁসির আদেশ বহালের প্রতিবাদে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালেও মাঠে দেখা যায়নি জামায়াত-শিবিরের কোন নেতাকর্মীকে। হয়নি পিকেটিং। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, এবারের হরতালেও আগের কর্মসূচীর মতো নাশকতার তথ্য ছিল। তাই ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল আমাদের। তবে জামায়াত কৌশল পাল্টেছে। তারা গ্রেফতার এড়াতে এখন গা-ঢাকা দিয়ে চলছে। এ কারণে চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে পোগানে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে সজাগ আছে বলে জানান গোয়েন্দা সংস্থার এ কর্মকর্তা। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর জন্য একটি শক্তিশালী টিম রয়েছে। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে থাকলেই তারা নাশকতার তাৎক্ষণিক ছক কষে যেকোন মুহূর্তে যেকোন স্থানে হামলা চালাতে পারে। বিশেষ করে গাড়িতে পেট্রোলবোমা ছুড়ে আগুন দেয়ার ক্ষেত্রে তারা খুবই ভয়ঙ্কর। দুর্বল ভেবে কখনই জামায়াত-শিবিরকে ছাড় দেয়া যাবে না। এবারের হরতালেও সকাল থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ রাখা হয়। প্রকাশ্যে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের কোন কর্মকা- নেই। এমনকি দলবদ্ধভাবে মিছিল নিয়ে তারা রাস্তায়ও নামতে পারেনি। তবে গোপনে তাদের কর্মকা- আছে। নেতারা আড়ালে থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভিডিও বার্তায় জামায়াত নেতারা ॥ এদিকে কর্মসূচী ছ্ড়াাও প্রতিমুহূর্তেই এখন জামায়াত নেতারা কর্মীদের কাছে ভিডিও বার্তায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। দুই শীর্ষ নেতা- দলীয় ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান সম্প্রতি কয়েকটি ইস্যুতে ভিডিওর মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সামনে হাজির হয়েছেন। দলীয় কর্মীদের তৈরি ফেসবুক পেজে এসব ভিডিও বার্তা প্রকাশ করা হয়। জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের সামনে আসতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান। মাঝখানে দুজনের স্বাস্থ্য নিয়েও নানা ধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যায় বলে তারা দুজনেই ভিডিওতে নিজেদের পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মকবুল আহমাদ ও ডাঃ শফিক দুজনেই আত্মগোপনে আছেন। রাজধানীতেই দলের বিশ্বস্ত কয়েক অনুসারীর বাসায় পালাক্রমে বাস করছেন তারা। মকবুল আহমাদকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ধানম-ির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেও দেখা গেছে। প্রথমবারের মতো একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে দেড় মিনিটের একটি ভিডিও বার্তা দেন মকবুল আহমাদ। তিনি বলেন, সাহসী যুবকরা, মুসলিম যুবকরা যারা ইসলামের প্রেরণায় উজ্জীবিত ছিলেন। ইসলামের প্রেরণায় তাদেরকে শাহাদাৎ বরণের জন্য উচ্চকিত করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি শফিকুর রহমানের ভিডিও বার্তা প্রকাশ হয় সম্প্রতি। ছাত্রশিবিরের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ টিমের তত্ত্বাবধানে ভিডিওগুলো তৈরি করা হয় এবং তা ইউটিউব, ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। মীর কাশেম আলীর রায়ের আগে প্রধান বিচারপতির দেয়া বক্তব্য নিয়েও ভিডিও বার্তা দেন জামায়াতের সেক্রেটারি। যেখানে প্রধান বিচারপতির মতামতের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা দিয়ে মীর কাশেম আলীর অপরাধকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালান জামায়াত নেতা। এর আগে গেল বছর তিন মাসের অবরোধকালে নাশকতা চালিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। ভিডিও বার্তাগুলোতে সালাহউদ্দিন হরতালের ঘোষণা দিতেন। তবে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার ভিডিও বিএনপির নেতার মতো মিডিয়ায় পাঠানো হয় না। শিবিরের ফেসবুক পেজ বাঁশের কেল্লায় প্রকাশ করা হয়। তার আগে পাঠানো হয় দলীয় কর্মীদের তৈরি ফেসবুক পেজে । গোপনে নাশকতার প্রস্তুতি ফাঁস! ॥ গ্রেফতার এড়িয়ে বড় ধরনের নাশকতার কৌশল নেয়ার তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে আগেই ছিল। তবে বৃহস্পতিবার যশোরে দলীয় কার্যালয়ের পাশে বাগানের মধ্যে নাশকতা পরিকল্পনার উদ্দেশে শিবিরের গুহা তৈরির ঘটনা ধরা পড়ার পর নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, যশোরের ঘটনা উদ্বেগজনক। যশোর পুলিশ বলছে, বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই শিবির কর্মীরা গুহা তৈরি করে। যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়ার গাইদগাছি আঞ্চলিক শিবির কার্যালয় পার্শ্ববর্তী মেহগনি বাগানের মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই কর্মকা-কে ভাল চোখে দেখছেন না স্থানীয়রাও। বৃহস্পতিবার শিবিরের এই গুহার সন্ধানের খবর ছড়িয়ে পড়লে গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
×