ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকড নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৩ মার্চ ২০১৬

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকড নিয়ে নানা প্রশ্ন

রহিম শেখ ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনায় ‘রহস্য’ ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালওয়ার ভাইরাস ইনস্টল করে অর্থ চুরি, নাকি হ্যাকারদের অর্থ চুরির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, না যোগসাজশে এই অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে- এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তদন্ত দল ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের সঙ্কেতলিপি ব্যবহার করেই যে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। তাই অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের দানা বাঁধছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দিকে। এদিকে আলোচিত এই ঘটনাটি দেশে নয়, দেশের বাইরে থেকে হ্যাকড করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করলেও বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, হ্যকাররা ম্যালওয়ার ইনস্টল করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে পড়ে, যখন ছিল ‘জিরো ডে’ (শুক্র ও শনিবার, ব্যাংক বন্ধের দিন)। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে শনিবার মধ্যরাতে রয়টার্স এ খবর নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা জনগণের আমানত সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সতর্ক করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন। সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট কোড (এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের সঙ্কেতলিপি) ব্যবহার করেই এ ধরনের ঘটনা ঘটায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি আরও জোরালো হচ্ছে। কারণ এই কোডের নির্দেশনাসংবলিত সঙ্কেত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারাই জানতেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু থেকেই এই অর্থ চুরির ঘটনায় হ্যাকারদের ওপরই সন্দেহের তীর বিদ্ধ করে আসছে। তবে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, ভুল নির্দেশনায় এই অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে এই ভুল নির্দেশনা কে বা কারা দিয়েছে সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন বক্তব্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে এই চুরি হওয়া অর্থের দায় কার। যদি ভুল নির্দেশনায় লেনদেনগুলো হয়ে থাকে, তাহলে ওই নির্দেশদাতা কে বা কারা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক আগেই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের সিস্টেমে কোন হ্যাকড হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংককেই দায়ী করছে। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ছয়জনকে শনাক্তের পর তদন্ত শুরু করেছে ফিলিপিন্সের এ্যান্টি মানিলন্ডারিং বিভাগ (এএমএলসি)। সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত সুইফট এখন পর্যন্ত কোথাও হ্যাক হয়নি। এ পদ্ধতি নানা ধাপে নিরাপত্তার জালে আবদ্ধ। সুইফটে যে বার্তা যায়, এটিও অনেক নিরাপদ। বার্তাটি যায় গার্বেজ আকারে। এটি যেখান থেকে পাঠানো হচ্ছে এবং যেখানে যাচ্ছে- দুই স্থানেই একই সফটওয়্যার থাকতে হবে। তা না হলে বার্তাটির ভাষা উদ্ধার করা যাবে না। ফলে ডলার চুরির নেপথ্যে ওই দুই স্থানের যে কোন এক স্থানের পদ্ধতি সম্পর্কে হ্যাকারকে জানতে হবে, যা হ্যাক করে জানা সম্ভব নয়। এছাড়া সব কম্পিউটার থেকে সুইফট বার্তা পাঠানোও সম্ভব নয়। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং (যে কক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়) রুম থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। ডিলিং রুমে এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে তিনটি বিভাগ কাজ করে। এর মধ্যে ফ্রন্ট অফিস বার্তা তৈরি করে, মিডল অফিস বার্তাটি পাঠায় এবং ব্যাক অফিস বার্তার আলোকে লেনদেন ঠিকমতো হচ্ছে কি-না তা তদারকি করে। ফ্রন্ট ও মিডল অফিসের তিনজন কর্মকর্তা জড়িত থাকেন লেনদেনের বার্তা পাঠাতে। যে কোন লেনদেনের আদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায় থেকে অনুমোদিত হলে ডিলিং রুমের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি বার্তা তৈরি করেন। আরেকজন কর্মকর্তা ওই বার্তাটি ঠিকমতো হয়েছে কি-না তা যাচাই করেন। অন্য এক কর্মকর্তা বার্তাটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠান। এসব লেনদেন ঠিকমতো হচ্ছে কি-না এবং লেনদেনের পর এ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ থাকল সেগুলো তদারকি করে ব্যাক অফিস। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ্যাকাউন্টস এ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের অধীন। এদিকে এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট এ্যান্ড বাজেট ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিসের (সিলিং) ৮ কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সিস্টেমে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট নম্বর, গোপন পাসওয়ার্ড ও বার্তা পাঠানোর সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে প্রচলিত নিয়ম মেনেই অর্থ লেনদেনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনার আলোকেই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ লেনদেন হয়েছে। তবে ব্যক্তির এ্যাকাউন্টে নির্দেশনার কারণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিস্টেমে এক সময় লেনদেনগুলো সন্দেহজনক বলে মনে হয়। তখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে বার্তা পাঠালে পরবর্তী নির্দেশনাগুলো স্থগিত রাখা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থ চুরির যে পাঁচটি নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে সেসব নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হয়নি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকও এই অর্থের নির্দেশনাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কি-না সেটি নিশ্চিত না হয়েই লেনদেন করেছে। ফলে তারা এর দায় কোনভাবেই এড়াতে পারে না। এ ঘটনার অগ্রগতি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম ও বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে যে ফরেনসিক টিম কাজ করছে তাদেরও ধারাবাহিক অগ্রগতি আছে এবং এ অগ্রগতি ফলপ্রসূ হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অনেকগুলো মিস ইনস্ট্রাকশন (ভুল নির্দেশনা) গিয়েছিল। কয়েকটি ইনস্ট্রাকশনের বিপরীতে রিজার্ভের অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে প্রবেশ করে এই নির্দেশনাগুলো দেশের বাইরে থেকেই পাঠিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত কমিটির সদস্য তানভির হাসান জোহা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের সঙ্কেতলিপি ব্যবহার করেই যে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। তবে যেখান থেকেই হ্যাকড হোক না কেন- প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা গেছে, ভাইরাস ইনফেকশন অথবা অভ্যন্তরীণভাবে পিন কোড না দিলে এ অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে ব্যাপক ডাটা চুরি হয়েছে। এটা ভবিষ্যতে মিস ইউজের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কে ঘটলো সেটা বের করা না গেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার আরও বড় আক্রমণের শিকার হতে পারে। তখন সার্ভার আফডেটও কোন কাজে আসবে না। আগামী দু-একদিনের মধ্যে এ ঘটনার বড় অগ্রগতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা ছাড়া এটা সম্ভব কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা যাচ্ছে না। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও না কারও সম্পৃক্ততা থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ফিলিপিন্সের জুয়ার বাজারের টাকা উদ্ধার হওয়া সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা ফেরত আনার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজি হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু এটা অত্যন্ত টেকনিক্যালি করা হয়েছে, তাই এটার প্রকৃত রহস্য বের করতে সময় লাগবে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্তা ছাড়া কী করে সম্ভব- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কে বা কারা জড়িত সেটা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। তবে হ্যাকাররা কম্পিউটার সার্ভারে ম্যালওয়্যার বা ভাইরাসজনিত কিছু পাঠিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাদের কাজই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সার্ভার ব্যবস্থায় এ ধরনের ভাইরাস পাঠানো। এটা ঢুকে গেলে তখন আর কারও সহযোগিতার দরকার হয় না। এদের কাজ আজ পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। তবে যেহেতু এ ঘটনায় যারা টাকা বের করে নিয়েছে, তাদের ধরা গেলে নেপথ্যে অন্য কেউ ছিল কি-না সেটিও বের করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কাজে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার লোকও ছিল। এ ঘটনায় তারা জড়িত থাকতে পারে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। সবই দেখা হচ্ছে। ‘জিরো ডে’তে ব্যাংক হ্যাকিং ॥ এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স শনিবার মধ্যরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাকাউন্ট দিয়ে কিভাবে টাকা তোলা যায় সেই সিস্টেমের ওপর সপ্তাহজুড়ে নজর রাখেন ওই হ্যাকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালওয়ার ইনস্টল করতে সমর্থ হয়। এরপর তারা এমন একটি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে পড়ে, যখন ছিল ‘জিরো ডে’ (শুক্র ও শনিবার, ব্যাংক বন্ধের দিন)। গত ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের মাঝে ঠিক সেই জিরো আওয়ারে এই হ্যাকিংয়ের কাজটি সম্পন্ন করে তারা। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, এক মাস ধরে ওই হ্যাকাররা বিভিন্ন এ্যাকাউন্ট থেকে এক বিলিয়ন ডলার আত্মসাত করার চেষ্টা করেছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এখন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিক কিভাবে হ্যাকাররা সিস্টেমটিতে ঢুকে পড়েছিল তা বের করার। ফায়ারআই ইনকর্পোরেশন এতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানটির চোখেই প্রথম হ্যাকারদের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করার বিষয়টি ধরা পড়ে। তদন্ত দলটি মনে করছে, হ্যাকিং প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও সুচারু। হ্যাকাররা এই কাজের জন্য ঠিক জিরো আওয়ারকে বেছে নেয়। ফলে হ্যাকিংয়ের দিনটি ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল নাকি ৫ ফেব্রুয়ারিতে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এই জিরো ডে যে কোন সফটওয়্যারের জন্য বরাবরই একটি নাজুক সময়। একবার সিস্টেমে ঢুকে পড়ে হ্যাকাররা দীর্ঘ সময় ধরে চুপচাপ বসে থাকে। কখনও তা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরও হতে পারে। এর বিপরীতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান এখনও বের করা সম্ভব হয়নি কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের পক্ষে। আরসিবিসি ব্যাংকের সিইও ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) প্রেসিডেন্ট এবং সিইও লরেঞ্জো তান। ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মাইয়া সান্তোস দিগুইতো পরোক্ষভাবে এই দাবি করেছেন। শনিবার ফিলিপিন্সভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইনকোয়ারার খবরটি নিশ্চিত করেছে। তান এই অর্থপাচারের বিষয়ে অবগত ছিলেন কিনা- জিজ্ঞাস করা হলে দিগুইতো জানান, তিনি এ সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন। তিনি আরও বলেন, আমি তাকে দোষারোপ করছি না। আমি শুধু ধারণা করছি, কারণ অর্থের পরিমাণটা বিশাল। আর এই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়ার পূর্বে ব্যাংকের কোষাগারে জমা করা হয়েছে। আর এ সম্পর্কে তার অবগত না থাকার কথা নয়। দিগুইতো আরও বলেন, ওই ৮১ মিলিয়ন ডলারের সঙ্গে আরও পেমেন্ট এসেছিল, যা জমা না দিয়ে ফেরত নিয়ে নেয়া হয় বলে ব্যাংকের সেটেলমেন্ট বিভাগ থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছিল। তবে তার পরিমাণটা কত, এ সম্পর্কে আমি জানি না। অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে জড়িত থাকার প্রশ্নে দুগুইতো বলেন, তারা আমাকে ফোন করেনি। কেবল ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। এখানে আমার কী অপরাধ! এদিকে আরসিবিসি প্রেসিডেন্ট এবং সিইও লরেঞ্জো তানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে ইনকোয়ারার। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ব্যাংকের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা ওই বিশাল অঙ্কের অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলে যে বিদ্বেষপূর্ণ এবং মামলাযোগ্য অভিযোগ আনা হয়েছে, আমি তার বিরোধিতা করছি। তান আরও বলেন, আমি চলমান তদন্তের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করব এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমিসহ ব্যাংকের পরিচালকরা নির্দোষ প্রমাণিত হব। ‘হ্যাকিংয়ের পর আরও সতর্ক বাংলাদেশ ব্যাংক’ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা জনগণের আমানত সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সতর্ক করা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে অবস্থানরত গবর্নরের সঙ্গে ভাইবারে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান। এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত না করতেও গণমাধ্যমকে অনুরোধ জানান গবর্নর। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ১শ’ কোটি ডলার চুরির চেষ্টার মধ্যে ৮৫ কোটি ডলার বেহাত হওয়া ঠেকানো গেছে। আর ১০ কোটি ডলারের মধ্যে দুই কোটি ডলার এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৮ দশমিক ১ কোটি ডলারও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত, হ্যাকাররা সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের জন্য তাদের ক্রেডেনশিয়াল চুরি করেই এই কাজ করেছে। হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে তার ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিকভাবে ফিলিপিন্সে নিয়ে যায়। পরে তা হংকংয়ের ক্যাসিনোগুলোতে সরিয়ে নেয়। আর ২০ মিলিয়ন ডলার যায় শ্রীলঙ্কার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু এই অস্বাভাবিক অঙ্কের অর্থ সরানোর সময় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটির নাম লিখতে বানান ভুল করে বসে হ্যাকাররা। ফলে তা আটকে যায় এবং বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ও ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের দুটি বড় লেনদেনের চেষ্টা চলছিল ওই পদ্ধতিতে। ‘ছায়া তদন্তে’ র‌্যাব ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব। আজ বাংলাদেশ ব্যাংকে যাচ্ছে সিআইডির একটি দল। তবে কি বিষয়ে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ হচ্ছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, ঘটনা জানার পর থেকেই তারা খোঁজ খবর নিচ্ছেন। র‌্যাবের কিছু বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলেন। তারা কথা বলেছেন। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাব বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেছে তারা। অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্তে পৃথক কোন উইং না থাকলেও এ ব্যাপারে গোয়েন্দা উইং এবং সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ উইং সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াড নামে সিআইডির একটি উইং থাকলেও ঘটনা তদন্তে তাদের কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন উইংয়ের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে কোন সাহায্য চাইলে তারা তা করতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির তরফ থেকে সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আজ সিআইডির একটি দল বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক করার কথা রয়েছে। তবে কি বিষয়ে বৈঠক হবে সে বিষয়টি ষ্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, টাকা চুরির বিষয়েই আলাপ আলোচনা হতে পারে।
×