ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জাতীয় জাগৃতি বনাম জোশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৩ মার্চ ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জাতীয় জাগৃতি বনাম জোশ

আমাদের জাতীয় চরিত্রের ভয়ঙ্কর একদিকের নাম আবেগ। মাত্র কিছুদিন আগে আমি হংকং হয়ে জয়পুর পাঞ্জাব বিহারের গয়া ও কলকাতা ঘুরে এলাম। বুঝলাম পাশ্চাত্যঘেঁষা দেশের সঙ্গে এসব জায়গার তুলনা চলবে না। কিন্তু এরা তো লাগোয়া প্রতিবেশী। ওপার বাংলার সঙ্গে আমাদের মিল সবকিছুতে আছে এবং থাকারই কথা। কিন্তু আবেগ ও উত্তেজনার মিলটা বরং লাহোর সীমান্তে দেখা পাকিস্তানীদের সঙ্গেই যেন বেশি। তাদের কাছে যেমন দেশপ্রেম মানে জং বা লড়াই, শুধু ভারতের বেলায় জোশ, আমাদেরও যেন তাই। আমাদের অবশ্য পাকিস্তান বিরোধিতাও আছে। তার একটা নিদারুণ মজা এই, যারা যৌবনে তা করে পরিণত বয়সে তারা ভারতবিরোধী হয়ে তা পুষিয়ে দেয়। যে কথা বলছিলাম, যে রাতে আবার হংকংয়ের পথে উড়ব তখন চলছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ। লংকার বিরুদ্ধে সে খেলায় আমাদের কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে কতিপয় ভারতীয় বোদ্ধার মন্তব্য আমার অনেকদিন মনে থাকবে। তারা যে পরিভাষায় কথা বলছিলেন তাতে বিদ্বেষের কোন চিহ্ন ছিল না। একটি নবীন ক্রিকেটপাগল জাতির বরং সেগুলো মনে রাখাই জরুরী। বাংলাদেশের পরাজয়ের পর বেলুনের মতো চুপসে পড়ার কোন কারণ নেই। যদি না আপনি ধারণা করে থাকেন যে, এ পরাজয় মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর কাজ করছে না। আপনার ধারণা, বিশ্বাস বা রিজিওন কথা শোনেনি। আমি খুব অবাক হয়ে দেখলাম এমন ধরনের আজগুবি সব মন্তব্যে সামাজিক মিডিয়া সয়লাব। ছোট ছোট খেলোয়াড়রা যখন তাদের ডাবল সাইজের নাক উঁচু ভারতীয় দাদা ও পাকি বেরাদরের কাঁধে কাঁধ রেখে চলছে তখন তাদের ওপর ভরসা না রেখে গায়েবি ও জোশ দিয়ে কি পার পাওয়া সম্ভব? এটা বুঝি নবীন মেধাও ধীরে ধীরে উঠে আসা দেশ কিছু তো ব্যাগ্র হবেই। তারপরও আমাদের চাই সংযম। এই একটা বিষয় রাজনীতি কেড়ে নিয়েছে প্রায়। তারা তাদের দলাদলি ও বিরোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে রক্তে। পাকিদের সঙ্গে সমান্তরাল ভারত বিরোধিতা মূলত প্রগতির পরাজয়। কিন্তু এটা যদি না করেন আপনি হবেন প্রশ্নবোধক। আড়ালে আপনাকে নিয়ে কানাঘুষা চলবে। আপনার সম্প্রদায় বিশ্বাস বা অন্য কোন কারণে আপনি জোশ ঢালতে পারেননি- এমন বিবেচনায় আপনি তখন দলে থেকেও নেই। পাকিদের বেলায় যেমন একই রাগ, ক্রোধ ও একটু অধিক জিঘাংসা রাখতে না পারলে শাহবাগের ভিড়ে দাঁড়ানো কাঁচুমাচু চেহারার এক উপস্থাপকের মতো হোপলেস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ভান করবেন; কিন্তু জোশ আসবে না। জোর করে কারও বিরোধিতা বা জোর করে কাউকে আপন ভাবা যায় না। শেষ হওয়া খেলাটি সামাজিক মিডিয়া ও মিডিয়ায় এটাই জানিয়েছে আমরা এখনও ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরে নিজেরে কর জয়’ বুঝি না। বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা ও সুযোগ এসব দিককে এড়িয়ে ডানা মেলতে পারবে না। বিদেশে এই ফাটল ও বিরোধিতা আরও বেশি। মধ্যবয়সীদের সঙ্গে রাতে খেলা দেখা এখন ঝুঁকির ব্যাপার। মারামারি শরীর খারাপ যে কোনটাই হতে পারে। জাতীয় জাগৃতি ও ঐক্য না থাকলে এ কাজ হবে না। আশা করছি আমরা তার পরিচয় দিতে পারব। বিজয়ের আনন্দ হাতছাড়া করার মতো হতভাগা নই আমরা। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন অতবড় বিজয় অত মৃত্যু ও রক্তের ওপর দাঁড়িয়েও কেমন অবিচল ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। সেদিন চাইলে আমরা প্রতিশোধ নিতেই পারতাম। মুক্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তা হতে দেননি। বরং যেসব মুক্তিসেনা আবেগ ও ক্রোধে চেতনাহীন হয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রাজাকারদের দিবালোকে হত্যা করেছিল, দেশ শাসক হিসেবে তিনি তা মেনে নেননি। কোন্টা সঠিক আর কোন্টা বেঠিক তার জবাব কি মানুষ জানে? জানে না বলেই সময় ও সভ্যতা নিয়মাবলী ঠিক করে দেয়। আজ যদি পিছে ফিরে তাকাই বেয়নেট হাতের সেই তেজী মুক্তিযোদ্ধার কোন্ চেহারা দেখি আমরা? এই কি সেই কাদের সিদ্দিকী যিনি পরে জামায়াতী টিভির টকশোওয়ালা? চেতনা ও নিজের জায়গা থেকে যোজন দূরে থাকা এক বিকৃত যোদ্ধা। আমরা পরিণত বয়সে এসে এদেশে হানাহানির বদলে একটি শান্ত সমাজ দেখতে চাই। আজ যখন এ লেখা লিখছি পরের দিন ক্রিকেটের মহারণ। আমাদের যৌবনে বাংলাদেশে ১১ জন খেলোয়াড় ছিল না। আমরা বুক ফুলিয়ে পতাকা দুলিয়ে মাঠে যেতে পারিনি। আমরা রাজনৈতিক ও সম্প্রদায়গত কারণে ভারত-পাকিস্তান এ দুদলে ভাগ হয়ে লড়াই করতাম। আর আজ আমি জয়পুর দিল্লী কলকাতা লাহোরে মুখে মুখে সাকিব মাশরাফি মুস্তাফিজের নাম শুনি; তারা বলে এমন কয়েকজন যদি তাদের থাকত! অহঙ্কারে আমার বুক ভরে যায়। একজন বলছিল বাংলাদেশের খেলার শৈলী উপমহাদেশের সেরা। থিতু হতে জানলে কেউ রুখতে পারবে না। ঠিক তাই। রাজনীতি তুমি তাকে পকেটে টেন না। তাকে থিতু হতে দাও। আমাদের তারুণ্য নোংরা রাজনীতি বোঝে না। তারা দেশের নামে পাগল। এ পাগলামিকে উন্মাদ করে হীন রাজনীতি। তাসকিনের হাতে ধোনির মু-ুকে জামায়াতীদের কাজ বলছি, মোল্লার সামনে কাঁচুমাচু পাকিস্তানীকে কি বলব বাকশালী ‘অনাচার’? দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খেলা ফিফা কাপের ফাইনালে সরকার প্রধানরা যায়। তাদের আবেগ হয় নিয়ন্ত্রিত। তোষামোদীর দেশে সবকিছু পকেটে ঢোকানো আর তিলকে তাল করার অপর নাম রাজনীতি। ফলে জয়টা হয়ে যায় একপেশে। আমার দেশের জয়টা আমাদের সবাইকে বিতরণ করুন। এই সেদিন নরেন্দ্র মোদি এসে সাকিব আল হাসানের কথা বলে গেলেন। আর এরা যারা এখানে এসে খেলে তারা আমাদের দেশের অতিথি। তাদের প্রশংসা করুন। তারাও দুনিয়ার বাঘা বাঘা খেলোয়াড়। অতিথির পরাজয়ে আমার জয় বড় হয় বটে, সমবেদনায় হয় আরও গৌরবময়। নিজেদের বড় করতে হলে খেলাকে খেলা, অতিথিদের অতিথি আর নিজেদের সম্মান করা শিখতে হবে। আমরা কোন না কোন সময় বিশ্বকাপের ফাইনালে জিতব এমন আশা নিয়েই বলছি- জয়তু ক্রিকেট। তার আগে সাম্প্রদায়িকতানির্ভর সমর্থন বন্ধ করতেই হবে। জয়তু বাংলাদেশ! [email protected]
×