ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৩ মার্চ ২০১৬

১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ

প্রবন্ধটি আকস্মিকভাবে শুরু করি। কিন্তু এটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন ভয়ে, অনেকে প্রশাসনে কাজ করেছেন, বীরের মতো যুদ্ধ করেছেন অনেকে; কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা তাদের অভিন্ন। সীমান্ত পাড়ি দেয়াটা ছিল যেন বীরত্বের। অবরুদ্ধ দেশে যারা ছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক নয়, ভীরু। কার জন্য যোদ্ধারা যুদ্ধ করছিলেন- একটি মানবশূন্য দেশের জন্য? বা অবরুদ্ধ দেশে মানুষ না থাকলে এক মুহূর্তের জন্য দেশে থাকতে পারতেন? এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতা আছে। অবরুদ্ধ দেশে যারা যুদ্ধ করেনি সরাসরি তাদের ছাড়াও তো নানা রকম প্রতিরোধ হয়েছে। দেশে থেকে যে প্রায় ২৫টি স্থানীয় বাহিনী লড়াই করেছে পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সেটি আরো বীরত্ববহ। এতদিন এসব বিষয়ে কিছু লিখিনি, বলিনি; কিন্তু এখন এর প্রতিবাদের সময় এসেছে। না হলে নিজ নিজ বীরত্ব দেখিয়ে সবাই বিভ্রম ছড়াবে। এ প্রসঙ্গে আমাদের এক সময়ের সুহৃদ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা উল্লেখ করেছি যিনি সুযোগ পেলেই বলেন শাহরিয়ার কবির ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সাপ্লাই দিতেন। শাহরিয়ার বা জাফরুল্লাহ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন। একজন সাংস্কৃতিক ও অন্যজন স্বাস্থ্য ফ্রন্টে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক মতের মিল না হওয়ায় এবং তিনি বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক হওয়ায় আজ যা খুশি বলছেন, তার মতো এ রকম আরো অনেকে আছেন। আমাদের এখন বাধ্য হয়ে বলতে হয় এমন কী বীরত্ব দেখিয়েছিলেন দেশ থেকে চলে গিয়ে, নিরাপদে হাসপাতালে কাজ করা ছাড়া। শাহরিয়ারকে এ বিষয়ে টেলিভিশনে প্রশ্ন করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মানুষ কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে তার প্রমাণ ডা. জাফরুল্লাহ। অপেক্ষা করছি কবে তিনি মাথার ঘায়ে দিগম্বর হয়ে চৌরাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করবেন। অবরুদ্ধ দেশের প্রতিরোধের নানা কাহিনী আছে। এখন এগুলোর সংকলন দরকার। ঐ ন্যারেটিভও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে। ॥ দুই ॥ পরাগের বাবার কুলখানিতে গেছি মিরপুর। পরাগ দীর্ঘদিন নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত, নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠানের ছবি তোলা থেকে পুস্তিকা বা প্রচারপত্রের গ্রাফিকসের দায়িত্ব তার। আমাদের বিশেষ স্নেহের পাত্র। মিরপুর আমাদের যাওয়া হয় না। কিন্তু ঐ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি কর্তব্য হিসেবে। কুলখানির পর খোদাদাদের সঙ্গে দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি, ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। খোদাদাদ অবশ্য ছিলেন অনেক সক্রিয়। তার সঙ্গে দেখা প্রায় দু’যুগ পরে। চেহারা বদলায়নি। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের বয়স হলেও চেহারা অপরিবর্তিত থাকে। খোদাদাদ সেরকম একজন। আমরা দু’জনেই খুশি হয়ে উঠি। খোদাদাদ এখন গ্রিন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক। এ বয়সে বহুদিন পর দেখা হলে, নাতি নাতনি, অসুখ বিসুখ এবং পুরনো স্মৃতির প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় আলাপের বিষয়বস্তু। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে আমাদের বয়সীদের স্মৃতিচারণায় ১৯৭১ আসবেই, কারণ ঐ সময়টা একই সঙ্গে আমাদের গভীর বেদনা ও আনন্দের সময়। ১৯৭১ এর প্রসঙ্গ উঠতেই খোদাদাদ বললেন, ‘আক্কাস ভাই (পরাগের বাবা) আমাদের সঙ্গে কত কাজ করেছেন। কে সে কথা মনে রাখে?’ জানতে চাইলাম কাজের ধরন। খোদাদাদ বললেন, ‘ঐ সময় আমরা সাইক্লোস্টাইল একটি পত্রিকা বের করতাম। অবরুদ্ধ ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অনেকে সেই পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন। অবরুদ্ধ দেশে সামান্য হলেও আমরা মনোবল জিইয়ে রেখেছিলাম।’ ‘কী পত্রিকা?’ জিজ্ঞেস করি আমি। ‘প্রতিরোধ! যা পরে স্বাধীনতা নামেও বের হয়েছিল।’ বিদ্যুত চমকের মতো আমার মনে পড়ে যায়, আমিও তো খানিকটা হলেও জড়িত ছিলাম সে পত্রিকার সঙ্গে। পত্রিকার কিছু কপিও ছিল আমার কাছে। ১৯৭২ সালের পর মাহবুবজামান ও হিলালউদ্দিন যুব ইউনিয়নের হয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বিরাট প্রদর্শনী করেছিল। তখন আমার কপিগুলো প্রদর্শনীর জন্য দিয়েছিলাম। আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে যা হয় তাই হলো। অর্থাৎ প্রদর্শনীর আগে এটি নেয়ার জন্য আমার বন্ধুদের মধ্যে যে আগ্রহ দেখেছিলাম, প্রদর্শনীর পর সেগুলো ফেরত দেয়ার ব্যাপারে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা গেল না। সেগুলো হারিয়ে গেল। বাসায় ফিরে আমি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জার্নাল ৭১ বইটি পড়লাম আবার। সেখানে দেখলাম এ পত্রিকা নিয়ে নানা তথ্য আছে। পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, পত্রিকার জন্য যেসব সংবাদ জোগাড় করা হয়েছিল সেসব কিছু কাগজপত্রও আছে। খোদাদাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলাম। তার কাছে তিনটি সংখ্যা (তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ-সপ্তম সংখ্যা) আছে। আরেকজনের কাছে পুরো সেট ছিল। সেগুলো পাওয়া গেল না। খোদাদাদ সেই তিনটি সংখ্যার ফটোকপি দিতে এলেন একদিন। বললেন, ‘এ নিয়ে একটা লেখা লিখুন’। প্রতিরোধ বের করার পটভূমিও বললেন। সেসব নিয়ে এই প্রবন্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে সাধারণত আমরা ১১টি সেক্টরের কথা বলি। এই ১১টি সেক্টরের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু এই ১১টি সেক্টরের মাধ্যমেই আমরা জয়ী হয়েছিলাম এই ধারণাটা এক-রৈখিক, কেননা মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অতুলনীয়। মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে রেখেছিল এ বেতার কেন্দ্র এটাকে আমরা বলতে পারি ১২ নম্বর সেক্টর। সারা পৃথিবীর সিভিল সমাজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে নিজ দেশের সরকারের বিরোধিতা করে। এদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে বিশ্বজনমত আমাদের অনুকূলে থাকত না। এটাকে আমি বলি ১৩ নম্বর সেক্টর। এই নামে আমার একটি বইও আছে। অবরুদ্ধ দেশে প্রায় ২৫টি স্থানীয় বাহিনী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এরা কখনও দেশ ছেড়ে যায়নি। এদের বীরত্ব গাথা আমাদের অগোচরে। এই সব বীর যোদ্ধা হয়ত মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও পায়নি। এরা উপেক্ষিত। এই স্থানীয় বাহিনীগুলোকে আমরা ১৪ নম্বর সেক্টর বলতে পারি। আর অবরুদ্ধ দেশ হচ্ছে ১৫ নম্বর সেক্টর। যা মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভে প্রায় অনুপস্থিত। ১৫ নম্বর সেক্টরে প্রায় সবাই যার যেভাবে সম্ভব মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করেছে। একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে কিন্তু উপেক্ষা করা হয়েছে অবরুদ্ধ দেশের মানুষের ভূমিকা। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন, মুক্তিফৌজের কথা আমরা বলি। কিন্তু দেশে থেকে স্থানীয় বাহিনী তৈরি করে যারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়েছিলেন তাদের কথা বলি না। বাংলাদেশে এ ধরনের বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫টি। এরাও তো মুক্তিফৌজের অন্তর্গত। প্রবাসে যারা চাকরি করেছেন (যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি বা ভয় ছিল না) তারা যতটা আদৃত, দেশে থেকে যারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ করেছেন তাদের কথা ভুলে যাই। অবরুদ্ধ দেশে এ ধরনের ‘পত্রিকা’ মানুষের মনোবল অটুট রাখতে সহায়তা করেছে। এ ধরনের কিছু পত্রিকা তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন গ্রুপ প্রকাশ করেছে তা আলোচনায় তেমন আসেনি। হাসিনা আহমেদ মুক্তাঙ্গনের পত্রপত্রিকা নিয়ে একটি কাজ করেছেন। সেখানে কিছুটা উল্লেখ আছে কিছু পত্র-পত্রিকার। সে সময়টা বোঝার জন্য এ ‘পত্র-পত্রিকা’গুলো গুরুত্বপূর্ণ। ॥ তিন ॥ খোদাদাদ জানালেন, যুদ্ধের শুরুতে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন তারপর আবার ফিরে এসেছিলেন। বামপন্থী দলগুলোর অনেকে ভেবেছিলেন তারা দেশেই কাজ করবেন। ছোট ছোট গ্রুপে তারা ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। এইসব গ্রুপে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ছিলেন। খোদাদাদের গ্রুপের নাম ছিল শহীদ তিতুমীর গ্রুপ। সৈয়দ কুতুবুর রহমান ছিলেন গ্রুপের প্রধান। তিনি ছিলেন ন্যাপের ঢাকার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। খোদাদাদ গ্রুপের আরও দু’জনের নাম জানালেন। আনিসুল ইসলাম ও জামান হায়দার। মুক্তিযোদ্ধা শরণার্থীদের সাহায্য, ওষুধপত্র জোগাড়, ঢাকার শহীদ পরিবারদের দেখাশোনা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়াএসব কাজই তারা করতেন। আমি ঢাকায় ছিলাম আমার বড় চাচা অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে তারা একটি গ্রুপ করেছিলেন। সেখানে ছিলেন অন্তত তখন জানতাম, ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জয়নাল আবেদিন প্রমুখ। গিয়াস স্যার কখনও কখনও রাতে আসতেন আমাদের বাসায় আলাপের জন্য। আমি তখন একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তার একটি কারণ, রাজনৈতিকভাবে এত সক্রিয় ছিলাম না। শাহরিয়ার সীমান্ত পেরোবার আগে দেখা করতে এলো আমার সঙ্গে। আমিও যেতে চেয়েছিলাম। চাচা অনুমতি দিলেন না যেহেতু আমি ছিলাম তার সঙ্গে। আমার বাবা-মা চাঁটগায়। যোগাযোগ নেই। তাকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যাওয়ার সাহসও ছিল না। আমার বিমর্ষ ভাব দেখে বললেন, ‘এখানেও অনেক কাজ করার আছে।’ অন্যান্য অনেক কাজের সঙ্গে তখন সাইক্লোস্টাইল একটি কাগজ বের করার পরিকল্পনা হয়। কুতুবুর রহমানই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমাকে মাঝে মাঝে দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের সংবাদ থেকে সংবাদ তৈরি করার বা বিভিন্ন জন বিশেষ করে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে ‘কাগজ’ পৌঁছে দেয়ার। সে কাজটির দায়িত্ব পালন করতেন মাঝে মাঝে বেবী মওদুদ। তিনি আমার পাশের রাস্তায় থাকতেন। ‘কাগজ’ যখন বের হয় তখন কপি দেখতাম। তখন এসব জানতাম না। খোদাদাদ ও বোরহানউদ্দিন খানের জার্নাল ৭১ পড়ে এসব জেনেছি। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, একদিন তিনি আমার ফুফুর বাসায় গিয়েছেন সেখানে তার সঙ্গে আলাপ কুতুবুর রহমান ওরফে কবিরের। পরিচয় হওয়ার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন “জিজ্ঞেস করলাম, খবর বলুন। খবরের জন্য উপোস করে আছি। কবির বললেন, ওপারের খবর সুবিধাজনক নয়। দলাদলি চলছে। কাজের চেয়ে বক্তৃতা বেশি হচ্ছে। তবু ছেলেরা যাচ্ছে, আমরা নিয়ে যাচ্ছি। পার্টি বুঝতে পেরেছে দেশের ভেতরে কাজ করতে হবে। দু-একজন এসেছেনও ভেতরে। দরকার এখন যোগাযোগ, সব স্তরে, পর্যায়ে। আমি বললাম, কাগজের ব্যাপারে কী করেছেন? কবির বললেন, জেলা কমিটি জানিয়েছেন ওপার থেকে কোন সাহায্য সম্ভব নয়। এখানকার সম্বলেই বের করতে হবে। ফের বললাম, মেশিন আছে? কবির বললেন, ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা তিনজন কেন্দ্রে থাকব। বের করা, বিতরণ করা, সব দায়িত্ব আমাদের। তবে কাগজটার বক্তব্য কাদের জন্য থাকবে? বললাম, সবার জন্য, কর্মী, সহানুভূতিশীল ব্যক্তি, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী দল সবার জন্য। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের ডাক একসঙ্গে দিতে হবে। যেখানে আমাদের ভিত্তি আছে, যেখানে গেরিলারা কাজ করতে আসে সব জায়গায়ই কাগজ ছড়াতে হবে। বক্তব্য বুনে দিতে হবে সবার মনে। চলবে...
×